You are currently viewing খিচুড়ির উৎপত্তি ও ইতিহাস

খিচুড়ির ইতিহাস ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে অন্তত এটা বোঝা গেল যে, খিচুড়ি নিয়ে যতই বাঙালি আবেগ থাকুক, এ খাবারের উত্স বাংলা নয়। খিচুড়ি রান্না হয় ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েই। তবে বাংলায় এর প্রবেশ খানিকটা পরে। যদিও ঠিক কোন সময় থেকে আমাদের দেশে এই খাবার তৈরি হচ্ছে তা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। শুধু ভারতে বেড়াতে আসা বিভিন্ন পরিব্রজাকের লেখা এবং কিছু দেশীয় গ্রন্থের সূত্র খিচুড়ির ঐতিহাসিক উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

Bangla Recipe” জন্য কারুকর্ম ব্লগে রেগুলার চোখ রাখুন

কারা কি বলেছেন

গ্রীক দূত সেলুকাস উল্লেখ করেছেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশে চালের সঙ্গে ডাল মেশানো খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিলো। আল বেরুনীও তাঁর ভারততত্ত্বে খিচুড়ির প্রসঙ্গ বাদ দিতে পারেননি। তিনি দেখেছিলেন, মূলত উত্তর ভারতে খিচুড়ি খুবই জনপ্রিয় খাবার। মরোক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা খিচুড়ি প্রস্তুতিতে শুধু চাল ও ডালের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, নির্দিষ্ট করে মুগ ডালের কথাও বলেছেন। চাণক্যের লেখায় মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে চাল ও ডালের মিশ্রণে তৈরি খিচুড়ির উল্লেখ মেলে। সুষম আহার প্রসঙ্গে চাণক্য লিখেছেন, এক প্রস্থ চাল (৬০০ গ্রাম মতো) ও সিকি প্রস্থ ডাল, ১/৬২ প্রস্থ নুন ও ১/১৬ প্রস্থ ঘি দিয়ে তৈরি খাবারই হল সুষম আহার। পিছিয়ে ছিলেন না গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসও। তিনিও চাণক্যের মতোই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভার রান্নাঘরে চাল ও ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি তৈরির কথা শুনিয়েছেন। পঞ্চদশ শতকে এ দেশে এসেছিলেন রাশিয়ান পর্যটক আফনাসিই নিকতিন। সুস্বাদু খিচুড়ি তাঁর চোখও এড়াতে পারেনি। তাঁর লেখায় দক্ষিণ ভারতে চাল-ডাল মিশিয়ে তৈরি খাদ্যের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আরও পরে সপ্তদশ শতকে ভারত পরিভ্রমণকারী ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের লিখেছেন, সে-সময় ভারতের প্রায় সব বাড়িতেই নাকি খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।

ইংল্যান্ডের কেডজ্রেই আদতে এই অঞ্চলের খিচুড়ি
ভিক্টরিয়ান যুগে দেশে ফেরা ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির হাত ধরে খিচুড়ি ইংল্যান্ডে পৌঁছায়।

আগের রাতের বেঁচে যাওয়া ডাল ও ভাত থেকে তৈরি হতো এই কেডজ্রেই। যা পরেরদিন সকালে নাস্তা হিসাবে খেতো। উপাদয় করতে, মাংস,ডিম, মাছ দেওয়া হতো।

বাংলায় তবে কবে

বাংলার হিসেব করতে বসে একটু ধন্দ্বেই পড়ে গেলাম। এটা ঠিক যে, ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে স্বয়ং শিব, পার্বতীকে যে রান্নাটির ফরমায়েশ করেছিলেন, তা ছিল খিচুড়ি। তাও আবার ডাবের জল দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি। আবার ওই কাব্যেরই অন্য এক জায়গায় এমনও বলা হয়েছে যে, ‘আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি’। অথচ ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এ লিখেছেন- ‘প্রাচীন বাঙালীর খাদ্য তালিকায় ডালের উল্লেখ কোথাও দেখিতেছি না।’ প্রশ্ন হল, খিচুরি রান্নায় যেহেতু চাল ও ডালের মিশ্রণ লাগবেই, তাহলে ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে চাল-ডালের খিচুড়ির কথা বলা হল কি করে? এর উত্তর সম্ভবত এমন হতে পারে যে, ‘মঙ্গলকাব্য’ মধ্যযুগে লেখা। অথচ নীহারঞ্জন রায় আরও আগের অর্থাৎ, প্রাচীন যুগের কথা বলেছিলেন। তাহলে কি এটাই দাঁড়ালো না যে বাংলার খিচুড়ি ঠিক ততটা পুরনো নয়! তাহলে কতটা পুরনো? ডাল ভারতীয় শস্য নয়। ডালের আদি ঠিকানা মূলত মধ্যপ্রাচ্য। সেখান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান দিয়ে উত্তর ভারত হয়ে বাংলায় আসে ডাল। তখন মধ্যযুগ। মধ্যযুগ বলতে ১২০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ের কথা বলা হচ্ছে। অতএব তখন থেকেই খিচুড়ির আবির্ভাব। নীহাররঞ্জন রায় জানাচ্ছেন, উচ্চবিত্ত লোকেরা তখন আহারের শেষের দিকে ডালের স্বাদ আস্বাদন করতেন। তখন মাছ সহজলভ্য হওয়ায় গরিবকে ডালের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত না। ‘গরীবের বাড়িতে চারটি ডাল-ভাত খেয়ে যাবেন’, এমন কথাও বলা হত না। হালে ডাল গরিবের আমিষ বলে খ্যাত হলেও প্রথম দিকে ডাল ছিল উচ্চশ্রেণীর খাদ্য।

খিচুড়ি প্রসঙ্গে- ‘খিচুড়ির চার ইয়ার-ঘি পাঁপড় দহি আচার’ কথাটি চালু থাকলেও বাঙালিরা খিচুড়ির সঙ্গে পাঁপড় ছাড়া অন্য কিছুতে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। ব্যতিক্রম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। সে বাড়ির রন্ধনপটিয়সীরা সেই কবে লিখে গিয়েছেন, ‘দই দিয়ে খিচুড়ি খাইতে মন্দ লাগে না।’

জোধপুরের প্রতিষ্ঠাতা রাও জোধা কে মেওয়ারের রানা কুম্ভ চিতোর থেকে উৎখাত করেন। সব হারিয়ে রাও জোধা পথে পথে ঘুরছেন আর চিতোর উদ্ধারের চেষ্টা করছেন ও বার বার বিফল হচ্ছেন।

শুনা যায় এক বাটি খিচুড়ি থেকে শিক্ষা পেয়ে উনি সফল হয়।
এক জাট চাষার ঘরে ক্ষুধায় কাতর হয়ে আশ্রয় নেন।

চাষীর বউ উনাকে চিনতে পারে না। উনার খাওয়ার জন্য এক বাটি খিচুড়ি খেতে দেয়। উনি না বুঝে খিচুড়ির মাঝে আঙ্গুল ডুবিয়ে আঙ্গুল পুড়ে ফেলে। তখনই চাষীর বউ বলে উঠে, তুমি আমাদের রাজা জোধা রাওয়ের মত ভুল করো। উনি যেরকম মাঝ দুর্গে আঘাত করে করে পরাজিত হয়, তুমিও তেমনই খিচুড়ির মাঝে আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুল পুড়ে ফেলেছো। খিচুড়ি খেতে হয় কিনার দিয়ে। খিচুড়ির মাঝে গরম ও চারপাশ ঠান্ডা।

এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জোধা রাও এরপর আর চিতোরের মাঝে আক্রমণ না করে, সীমান্ত অঞ্চলে আক্রমণ করে করে, পনেরো বছর পর আবার চিতোর উদ্ধার করে।

খিচুড়ির শতনাম

রাজ্যযে নামে পরিচিতরাজ্যযে নামে পরিচিত
পাঞ্জাবতুর ডাল খিচড়িবিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগডভুঞ্জি খিচড়ি
হরিয়ানাবজরা খিচড়িরাজস্থানকাথিয়াওয়াড়ি খিচড়ি
জম্মু ও কাশ্মীরমং খেচিরনাগাল্যান্ডগালহো
উত্তরাখণ্ডউরদ খিচড়িমনিপুরমনিপুরী খিচড়ি
গুজরাটভাগারেলি খিচড়িমিজোরামকালো চালের খিচড়ি
মহারাষ্ট্রভালাচা খিচড়িগোয়ামিষ্টি খিচড়ি
ওড়িষামিঠা খিচড়িমধ্যপ্রদেশসাবুদানা খিচড়ি
অন্ধ্রপ্রদেশপুলাগামতামিলনাড়ুভেন পোঙ্গল
কর্ণাটকখারা পোঙ্গল
খিচুড়ির শতনাম

খিচুড়ি প্রেমে মজলো মুঘল

বাবর বা হুমায়ুনের কালে খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়নি এটা ঠিক, তবে আকবরের সময় থেকে মুঘল হেঁশেলে খিচুড়ির উল্লেখ মিলতে থাকে। আকবরের মন্ত্রী ছিলেন আবুল ফজল। সুলেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তাঁর লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে নানা ধরনের খিচুড়ি তৈরির প্রসঙ্গ আছে। জানা গেছে, তখন রাজকীয় মুঘল রান্নাঘরে নাকি বিভিন্ন ধরণের খিচু়ড়ি তৈরি হত।

এমনকী, সেই বইয়ে ‘বীরবলের খিচুড়ি’ নামে একটি মজার গল্পের উল্লেখও পাওয়া যায়। সেখানে আকবর এবং বীরবলের খিচুরি রান্নার কথা বলা হয়েছে। খিচুড়ির প্রতি ভালো লাগা ছিল জাহাঙ্গিরেরও। জাহাঙ্গিরের প্রিয় খিচু়ড়িতে থাকত পেস্তা ও কিসমিস। সেই খিচুড়িকে জাহাঙ্গির ভালবেসে নাম রেখেছিলেন ‘লাজিজাঁ’। মুঘল রান্নাঘরে আর এক ধরনের খিচুড়িতে চাল ও ডালের সঙ্গে মেশানো হত বিভিন্ন প্রকার মাছ ও ডিম। এই খিচুড়ির নাম ‘আলমগিরি খিচড়ি’। আশা করি এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছেন যে, এই খিচুড়ি ছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রিয়।

হুমায়ুন যখন শেরশাহের তাড়া খেয়ে পারস্য পৌঁছালেন, সেখানকার শাহ কে তিনি নিমন্ত্রন করে ভারতীয় খিচুড়ি খাওয়াছিলেন। আর তা খেয়েই না কি শাহ ঠিক করলেন, হুমায়ুন কে পারস্যে আশ্রয় দিবেন।

আকবরের সময় আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরই তে সাত রকমের খিচুড়ির রেসিপি লিখেছেন।

মুঘল বাদশাহদের খিচুড়ি প্রীতি বংশানুক্রমে চলতেছিলো।
জাহাঙ্গীর একবার গুজরাটে ভুট্টার খিচুড়ি খেয়ে মোহিত হয়ে মুঘল হেঁসেলে জায়গা দেয়।

বিদেশেও

কী আশ্চর্য! ১৯ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭-১৯০১) খিচুড়ি ইংল্যান্ডের হেঁশেলে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সৌজন্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেই সব কর্মচারী, যাঁরা দেশে ফিরে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে এই খিচুড়ি ব্রিটিশ-রসনা মিশ্রিত হয়ে জনপ্রিয় ইংলিশ প্রাতরাশ ‘কেডগেরি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কেডগেরিতে থাকে মাছ, কেইন পেপার ও সেদ্ধ ডিম। মোটামুটি ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়েই নিম্নবিত্ত মিশরীয়দের মধ্যে ‘কুশারি’ নামে একটি রান্না জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘কুশারি’ তৈরী হতো চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ইত্যাদি উপকরন দিয়ে। পরে এই রান্নাটি সৈন্যশিবিরেও স্থান পায়। রন্ধন প্রনালী অনুসরণ করলে ‘কুশারি’কে খিচুরির-ই ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে। এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেও খিচুড়ির প্রচলন আছে। এই খিচুড়িকে ‘কঙ্গি’ বলা হয়।

বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি- কেন?

বর্ষা, বাঙালি এবং খিচুড়ি- এই ত্রয়ীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বৃষ্টির দিনগুলিতে বাঙালি খিচুড়ি খেতে খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু কেন? আসলে গ্রাম বাংলায় বর্ষাকাল ছিল বিড়ম্বনার সময়। প্রবল বর্ষায় বাজারহাট, রান্নাবান্না করা খুব অসুবিধেজনক হয়ে পড়ত। গৃহস্থবাড়ীতে তখন রান্নাঘর থাকত একটু বাইরের দিকে। সেখানে রান্না করতে গিয়ে ভিজে একসা হতে হত। এই সময় বাড়ির গৃহিনীরা চাল ও ডাল মিলিয়ে খুব দ্রুত ও ঝামেলা মুক্ত ভাবে রেঁধে ফেলতেন খিচুড়ি। ঘরে আলু বা অন্য কোনও সবজি থাকলে তা চট করে খিচুড়িতে ফেলে দিলে অসুবিধে হত না। এ সব কারণেই বৃষ্টির দিনের সঙ্গে খিচুড়ি সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বর্ষায় তাজা ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তাই খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজাও জড়িয়ে গেছে। অন্য একটি ব্যাপারও লক্ষ্যণীয়। খিচুড়ি এমনিতে গুরুপাক খাবার। এতে অনেকের হজমের সমস্যা হয়। বৃষ্টির সময়ে ঠান্ডা আবহাওয়ায় খিচুড়ি খেয়ে এই অসুবিধে অনেকখানি কাটিয়ে ওঠা যায়।

লিখেছেন – কৌশিক রায় ( কিছুটা পরিবর্ত ও পরিবর্ধন করা )

Leave a Reply