সিলেট: বাংলাদেশের প্রথম নারী প্যারাট্রুপারের খ্যাতি অর্জন করলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস। এক হাজার ফুট উঁচু থেকে প্যারাস্যুট দিয়ে মাটিতে অবতরণের মধ্য দিয়ে এক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি এ সম্মান অর্জন করলেন। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্যারাট্রুপারের গৌরব অর্জন করেছেন ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস। বৃহস্পতিবার জালালাবাদ সেনানিবাসের পানিছড়া প্যারাট্রুপিং জোনে তিনি ১০০০ মিটার উচ্চতায় বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ থেকে প্যারাসুট জাম্প করে সফলভাবে মাটিতে অবতরণ করেন।
তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে। বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
যখন তার বাবা-মা সব সময় বলতেন “কোনও মেয়ে তো যায়নি, তুমি কেন? তিনি বলতেন, কাউকে না কাউকে তো একদিন যেতে হবে। ভয়ের কিছু নেই!”
জান্নাতুল ফেরদৌস এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এ কোর্সকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। এর মাধ্যমে অন্য মেয়েরা এ কোর্সের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন। ”
মঙ্গলবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে তিনি সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসের পানিছড়া এলাকায় বিমানবাহিনীর এক বিমান থেকে প্যারাসুট এর মাধ্যমে সফলভাবে অবতরণ করেন। এর মাধ্যমে তার প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ হয়।
সিলেটের পানিছড়ার যে এলাকায় ওই প্রশিক্ষণ চলছিল সেখানে সামরিক বাহিনীর কমকর্তাদের পাশাপাশি এসেছিলেন স্থানীয় অনেক লোকজনও।
তারাও একজন নারীকে এমন চ্যালেঞ্জ নিতে দেখে অভিভূত। তাদের মধ্যে অনেকেই ক্যাপ্টেন জান্নাতকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করলেন।
সেই মুহুর্তটিতে সেখানে হাজির থাকতে সকাল দশটার আগেই সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে পৌছে যায় সিলেট ওসমানী অঅন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
নেমেই চোখে পড়ে প্যারাট্রুপার দলের সদস্যদের অনুশীলন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উড়োজাহাজে আকাশে উড়বেন এবং ঝাঁপ দেবেন ভূমিতে। চলছিল তারই শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি।
এই দলের চল্লিশ জনেরও বেশি সদস্যের সবাই পুরুষ, শুধু একজন ছাড়া। আর তিনিই প্রথম নারী জান্নাতুল ফেরদৌস।
কিন্তু প্যারাট্রুপার হিসেবে নিজেকে গড়ার স্বপ্ন কীভাবে তৈরি হলো? আর এই কাজটাকেই বা কতটা ঝুঁকির বা চ্যালেঞ্জের মনে হয় ?
মাটি থেকে এক কিলোমিটার ওপরে তখন বিমানটা। ফেব্রুয়ারী মাস, বাংলা ক্যালেন্ডারে মাঘ মাস চলছে। কণকণে ঠান্ডার মধ্যেও ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌসের কপালে ঘাম জমেছে, সেটা উত্তেজনায়, নাকি নার্ভাসনেসের কারণে, বোঝা যাচ্ছে না ঠিকঠাক। আর কয়েকটা সেকেন্ড, তারপরই শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দেবেন তিনি, প্যারাকমান্ডো ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে তাকে প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ দিতে হবে এক হাজার মিটার ওপর থেকে। যে কাজটা এর আগে কোন বাংলাদেশী নারী করেননি, সেটাই করতে চলেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস!
পাঁচ সপ্তাহের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে দিনে ও রাতে মোট সাতবার আকাশ থেকে নেমে আসতে হয়। এক হাজার ফুট উঁচু থেকে এই অবতরণের ঠিক পরমুহুর্তেও রোমাঞ্চ প্রকাশ পায় বাংলাদেশের এই একমাত্র নারী ছত্রীসেনার কন্ঠে।
একজন পুরুষ সদস্য জাম্প করে নিচে পড়ার সময় তার প্যারাস্যুট খুলতে না পারায় সমবেত সকলের উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। তবে শেষ মুহুর্তে অতিরিক্ত প্যারাশুটটি খুলতে পারায় বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান তিনি।
এদিন দুপুরে এক অনুষ্ঠানে তাকে বেইজ পরিয়ে দেওয়া হয়।
জান্নাতুল গত ১৩ জানুয়ারি সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসের স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্স’র (এসআইএনট্রি) বিশেষ যুদ্ধ শাখার অধীনে পরিচালিত ব্যাসিক প্যারা কোর্সে অংশ নেন। বাংলাদেশ তথা সেনাবাহিনীর প্রথম নারী প্যারাট্রুপার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি।
কোর্সটি ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আবহাওয়ার কারণে ১২ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে।
জান্নাতুল ফেরদৌসের এ সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপিং দলে একজন নারী সদস্য যোগ হলেন।
ছত্রীসেনা দলের প্রধান প্রশিক্ষক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন বিশ্বের অন্য অনেক দেশেই মেয়েরা দক্ষতার সাথেই কাজটি সম্পন্ন করছে।
এখানেও সামরিক বাহিনীতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীর ছত্রীসেনা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার পথ উন্মুক্ত । এছাড়া দুযোগপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশে তা আরো জরুরি।
জান্নাতুল ফেরদৌস নিজেও আশা করেন, সামনের দিনগুলোতে তাকে দেখে আরো অনেকেই উৎসাহী হবেন।
সেনাবাহিনীর বিশেষ যুদ্ধ শাখার প্রধান প্রশিক্ষক লে. কর্নেল একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, “সেনাবাহিনীর কোনো নারী কর্মকর্তা এ প্রথম প্যারাসুট থেকে জাম্প দিলেন। ”
তবে নারী হিসেবে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা থাকায় সেই বিষয়টি বিবেচনা করেই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হয় বলে জানান প্রধান প্রশিক্ষক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম।
তিনি মনে করেন জান্নাতের এই অর্জন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য একটি মাইলফলক।
মঙ্গলবার সপ্তম দিনের মতো প্যারাট্রুপিংএর মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ হয় জান্নাতুল ফেরদৌসের।
এর পর অন্যান্য পুরুষ সহকর্মীদের সাথে তাকেও ব্যাজ পরিয়ে দেওয়া হয় এবং এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো দলের একজন সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যে কিনা স্থল, নৌ এবং আকাশ সবদিকেই চৌখস ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন।
উপস্থিত সকলে তাঁর এই সাফল্যকে করতালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, “১৯৯০ সাল থেকে সেনাবাহিনীতে এ কোর্স চালু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার সেনা সদস্য এ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে ৫ শ’ সেনা কর্মকর্তাও রয়েছেন। তবে, নারী কর্মকর্তা হিসেবে প্রথম অংশ নিলেন জান্নাতুল। এর মাধ্যমে অন্য নারী কর্মকর্তারা এ প্রশিক্ষণে অনুপ্রাণিত হবেন। ”
ক্যাপ্টেন জান্নাদুল ফেরদৌস ২০০৮ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ৫৯তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন এবং বর্তমানে তিনি বিএমএ-এর একজন কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, “খুব ভালো লাগছে। আমি রোমাঞ্চিত। মনে হচ্ছে আরেকবার জাম্প দিই। এটা সাহসিকতাপূর্ণ কাজ। প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম তবে, প্রশিক্ষণ শেষে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হয়েছে। ”
জানা গেছে, সাহসী এ সেনা কর্মকর্তা ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৫৯তম বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীতে মিলিটারি একাডেমির কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে প্যারাট্রুপার বা ছত্রীসেনা হিসেবে এই প্রথমবার নাম লেখালেন কোনো একজন নারী সদস্য।