আমরা কম-বেশি সবাই সংসারের খরচ কমাতে চাই। দৈনন্দিন জীবনে চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই।হু হু করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। কিছুতেই রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না সংসার এর খরচের। আয়ের তুলনায় ব্যয়ের মিল নেই। তাই মাস শেষে ভোগান্তিতে পড়ছেন অনেকে। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই আপনি আপনার প্রতি মাসের খরচ যেমন কমিয়ে আনতে পারেন, তেমনি পারেন সেই টাকা থেকে কিছুটা আপনার ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয় করতেও!
সব খরচের তালিকা
আপনি হয়তো প্রতিদিন একাধিকবার ১০০ টাকা খরচ করছেন। কিন্তু, ভাবেন ‘মাত্র ১০০ টাকা, খুব বেশি নয়’। তবে, আপনার ধারণা পাল্টে যাবে যদি আপনি এই কৌশলটি অবলম্বন করেন। প্রতিদিন যতবার ১০০ টাকা খরচ করছেন তা লিখে রাখুন। পুরো মাসজুড়ে এটি করুন। তারপর মাস শেষে একবার পুরো খরচ যোগ করে দেখুন, আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কারণ, মাস শেষে আপনার মাত্র ১০০ টাকা খরচের যোগফল কিন্তু বেশ বড়ই হবে। এই বিষয়টি আপনাকে অনেক খরচ কমাতে সহায়তা করবে। আপনি অদরকারি খরচের খাত চিহ্নিত করতে পারবেন।
ইমারজেন্সি ফান্ড
শতকরা অর্ধেক মানুষই তাদের ইমারজেন্সি ফান্ড আলাদা করে রাখেন না কিন্তু সবার জীবনেই কখনো না কখনো এটির প্রয়োজন হয়। চাকরি হারানো বা ব্যবসায়ে ক্ষতি হওয়া, চিকিৎসা ব্যয় বা অন্য কোনো কারণে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হয়। ফাইন্যান্স এক্সপার্টরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন যে, অন্তত ছয় মাসের জীবন-যাত্রায় ব্যয় আলাদা করে রাখা উচিত। করোনা মহামারী তার অন্যতম উদাহরণ। লকডাউনে মানুষের কাজ ছিল না আবার অনেকই কাজ হারিয়ে পথে বসেছে। হঠাৎ সৃষ্ট এসব বিপদের কথা চিন্তা করে হলেও ইমারজেন্সি ফান্ড আলাদা করে রাখা উচিত। এই অর্থটি এমন একটা একাউন্টে রাখুন যার ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড থাকবে না। শুধুমাত্র প্রয়োজন হলেই আপনি এই টাকাতে হাত দিবেন। এটি আপনার বিপদে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে। যখন আপনি কাজ করতে পারবেন না তখন আপনার হয়ে এই ফান্ডটি কাজ করবে। তাই সংসার এর খরচ কমাতে ইমারজেন্সি ফান্ড করুন।
মাসিক বাজার একসঙ্গে কিনুন
সংসার এর কাঁচা বাজার ছাড়া চাল, ডাল, তেল, লবনসহ বাকি সব কিছু এক মাসের জন্য একবারে কিনে রাখুন। এতে আপনার বারবার বাজারে যাওয়ার জন্য খরচ আর সময় দুটোই বাঁচবে।
বাইরের কফি বাদ
আপনি হয়তো নিয়মিত বাইরে কফি পান করেন। কিন্তু, এটা বাদ দিতে পারেন। তাহলে আপনার খরচ কমে যাবে। প্রয়োজনে বাসায় কফি বানান। তারপর তা একটি ফ্লাস্কে ভরে কর্মস্থলে নিয়ে যান। আপনি যদি সত্যিই ব্যয় কমাতে চান তাহলে এই অভ্যাসটি খুবই জরুরি। এতে প্রতিমাসে আপনার খরচ কমবে।
নিজের কাজ নিজে করতে চেষ্টা করুন
সামান্য চেষ্টা বা শ্রম দিলেই যে কাজটি আপনার নিজের পক্ষে করা সম্ভব, সেটি নিজেই করে ফেলুন। বাইরের লোক দিয়ে করিয়ে অযথা পয়সা নষ্ট না করলেই মাস শেষে বেঁচে যেতে পারে কিছু অর্থ।
সাইকেলে বা হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া
আপনার কর্মস্থল যদি বাসার কাছাকাছি হয়। তাহলে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে কর্মস্থলে যেতে পারেন। এই অভ্যাস খরচ কমানোর জন্য খুবই কার্যকরী উপায়। আবার একইসঙ্গে আপনার জন্য ব্যায়ামও হয়ে যাবে, আপনি ফিট থাকবেন।
খরচের বেলায় প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন
ধরুন, কেউ তার প্রয়োজন ও সাধ্যমতো বিদেশি ব্র্যান্ডের প্রসাধনী কিনলো। সেটি হয়তো তার সামর্থ্যের ভেতরে। এখন যদি তার কেনা দেখে আপনি আপনার সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কিনতে যান, তাহলে সেটা হবে অসুস্থ প্রতিযোগিতা; যা আপনাকে আর্থিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।
খাত বরাদ্দ করে নিন
মাসের শুরুতেই খরচের খাত বরাদ্দ করে নিন। অর্থাৎ কোন খাতে কত খরচ করবেন বা খরচ করার সামর্থ্য রাখেন, সেটি বিবেচনা করে নোটবুকে খাত হিসাব করে নিতে পারেন। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ, বাড়িভাড়া, বাজারখরচ, যাতায়াত, ওষুধপথ্য, অতিথি-মেহমান ও আনুষঙ্গিক খরচের খাত আগেবাগেই হিসেব করে রাখা যেতে পারে।
ব্র্যান্ডের পণ্য এড়িয়ে চলা
সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস আমরা ব্রান্ড থেকে কিনে থাকি। কিন্তু, খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে ব্রান্ডের পণ্য আর সাধারণ পণ্যের স্বাদে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাই ব্র্যান্ডিংয়ে প্রলুব্ধ হবেন না। আপনি হয়তো ব্রান্ডের জুস বা প্রক্রিয়াজাত অন্যান্য খাবার কিনছেন। অথচ চাইলেই এগুলো বাসাতে বানানো যায়। তাহলে শুধু শুধু এজন্য কেন অতিরিক্ত টাকা খরচ করবেন?
বাসার খাবার খাওয়া
আমরা অনেক সময় বাইরের খাবার খাই। কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ব্যয়বহুল কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাই। কিন্তু, কখনো ভেবে দেখেছেন এজন্য প্রতিমাসে আপনাকে অতিরিক্ত কতগুলো টাকা খরচ করতে হয়। তাই এই অভ্যাস এড়িয়ে চলুন। কোনো বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে হলে চেষ্টা করুন বাসায় রান্না করে খাওয়ার। এতে খরচ সাশ্রয় হবে আবার পরিবারের সবার সঙ্গে সম্পর্কটাও মজবুত হবে।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা
আমার অনেকেই গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ে সচেতন না। অথচ আমাদের সংসারের প্রতিমাসের নিয়মিত খরচের দুটি খাত গ্যাস ও বিদ্যুৎ। তাই গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহারে খুব সচেতন হতে হবে। তাহলে এখান থেকেও সংসার এর কিছু খরচ কমাতে পারবেন।
দামি পানীয় এড়িয়ে চলা
দামি কোল্ড ড্রিংকস ও সফট ড্রিংকস পান করা অনেকের নিয়মিত অভ্যাস। অথচ, এগুলোর কার্যত কোনো উপকার নেই। সহজ কথায় বলতে গেলে এগুলো এক ধরনের অপচয়। তাই এই অভ্যাস বাদ দিতে হবে। তাহলে এই খাত থেকেও বেশ কিছু খরচ কমানো সম্ভব হবে। আসল কথা, যে জিনিসের কোনো সুবিধা নেই তার পেছনে অর্থ ব্যয় করার কোনো মানে হয় না।
কয়েন সংগ্রহ
প্রতি মাসেই আমাদের হাতে অনেকগুলো কয়েন আসে। যার কোনো হিসাব থাকে না। সেগুলো হারিয়ে গেলেও আমরা জানতে পারি না। এক্ষেত্রে একটি পাত্র ঠিক করতে পারেন। তারপর সেই পাত্রে কয়েনগুলো জমাতে পারেন। মাস শেষে কয়েনের পরিমাণ দেখে আপনি হয়তো অবাক হবেন। কারণ, সেখানে জমানো কয়েনের টাকার অঙ্কটা বেশ বড়ই হবে।
পুরনো জিনিস বিক্রি
সংসার এর এমন অনেক জিনিস থাকে যেগুলো কাজে লাগে না। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে। পুরনো হয়ে যাওয়ায় এই জিনিসগুলো ব্যবহার করা হয়ে ওঠে না। কিংবা হয়তো ব্যবহারের দরকার হয় না। কিন্তু, যে জিনিসটা আপনার জন্য অদরকারি, সেটা অন্য কারো কাছে বেশ দরকারি হতে পারে। তাই পুরনো অদরকারি জিনিসগুলো বিক্রি করে দিন। তাহলে সেখান থেকে কিছু অর্থ আসবে। আজকাল পুরনো জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। পুরনো জিনিস কেনাবেচার অনেকগুলো অনলাইন প্লাটফর্মও আছে।
অনলাইন সাবসক্রিপশন কমানো
আধুনিক সময়ে আমরা বিনোদনের জন্য অনেকে অনলাইন প্লাটফর্মের সাবসক্রিপশন নিয়ে থাকি। কিন্তু, সেসব প্লাটফর্মে মুভি, ড্রামা বা অন্যকিছু দেখা হয় না। তাই এসব প্লাটফর্ম আনসাবসক্রাইব করে নিন। তাহলে এখান থেকে প্রতিমাসে কিছু টাকা কমাতে পারবেন। যা আপনার সংসার খরচ যোগাতে সহায়ক হবে।
ঋণ শোধ করুন
মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই সবার আগে আপনার ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করুন। পুরোটা না পারলেও যতটা সম্ভব করুন। ঋণ শোধ না করে সঞ্চয়ের পথে বা ভুলেও বাড়াতে যাবেন না।
বিলাসবহুল সৌন্দর্যপণ্য এড়িয়ে চলা
ত্বকের বলিরেখা থেকে মুক্তি পেতে এবং ত্বক সুন্দর রাখতে আমরা দামি ক্রিম ব্যবহারে প্রলুব্ধ হয়ে থাকি। কিন্তু, বাস্তবে ত্বকের প্রয়োজন হলো একটি ভালো ডায়েট। দরকার প্রচুর পরিমাণে পানি ও হাইড্রেশন। এজন্য ব্যয়বহুল ক্রিমের পরিবর্তে বাদাম বা নারকেল তেল ব্যবহার করুন। এতে ত্বক ভালো থাকবে আবার সংসারের খরচও কমবে।
জিমের সদস্যপদ বাতিল করা
ব্যায়াম বা ওয়ার্কআউটের জন্য জিমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জিমের পরিবর্তে সাইকেল চালিয়ে, পার্কে হেঁটে ও দৌড়িয়ে কিংবা বাড়িতে ভারোত্তোলন করে ব্যায়াম করতে পারেন। আবার যারা জিম ছাড়তে চান, তাদের নিয়ে একটি গ্রুপ গঠন করতে পারেন। তারপর তাদের সঙ্গে বাইরে নিয়মিত ওয়ার্কআউট সেশন করতে পারেন। তাহলে ফিট থাকার জন্য অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে না।
কার্ডে নয়, নগদ লেনদেন
প্রতি সপ্তাহে খরচের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ করুন এবং শুধু সেই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করুন। তবে, অবশ্যই নগদ টাকা খরচ করবেন। কারণ কার্ডে লেনদেন করলে আপনি নিজেও জানতে পারবেন না কত টাকা খরচ করে ফেলছেন। তাই কার্ড নয় নগদ লেনদের করুন। তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যা আপনাকে খরচের ব্যাপারে সাবধানী হতে সহায়তা করবে।
সন্তানকে সঞ্চয় করতে শেখান
সন্তানকে ছোট্ট একটা ব্যাঙ্ক কিনে দিন। মাটির বা প্লাস্টিকের। খুব রঙ্গিন বা আকর্ষনীয় পুতুল আকারের ব্যাঙ্ক কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলোর একটা কিনুন ও তাকে টাকা জমাতে সাহায্য করুন।
মোবাইল বা টেলিফোন বিল কমান
মোবাইলে মাসিক কোন প্যাকেজ ব্যবহার করলে কম রেটে বেশি কথা বলা যাবে বা কত টাকায় কত মিনিট ও কত ইন্টারনেট পাওয়া যাবে সেসব বিষয়েও ধারণা রাখুন। এসব ছোট ছোট হিসাবগুলো কষা থাকলে সংসার এর খরচ অনেকখানি বাঁচবে। সেইসঙ্গে কোন বিষয় বাবদ বেশি খরচ হচ্ছে; সেটিও মাথায় থাকবে।
ছাড়ের সময় পণ্য কিনুন
অলংকার বা অন্যান্য পণ্যের দামে বছরের বিশেষ কিছু সময়ে ছাড় দেয়া হয়। চেষ্টা করুন সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে পণ্যটি কেনার। এতে আপনার বেশ কিছু টাকা বেঁচে যাবে।
সঞ্চয় নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকা
অর্থের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনুন। পর্যাপ্ত আয় না করা বা পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ না থাকার জন্য নিজেরে প্রতি অভিযোগ করবেন না। এর পরিবর্তে আপনার যা আছে তাই নিয়ে কৃতজ্ঞ থাকুন। মনোভাবের এই বদল ব্যয় কমাতে কতটা সহায়তা করতে পারে তা দেখে আপনি অবাক হবেন।
খরচের হিসেব রাখুন
প্রতিদিন কোথায় কত ব্যয় হল তার হিসেব একটা খাতায় লিখে রাখুন। মাস শেষে সেটি নিয়ে বসুন। এবার দেখুন কোন কোন খাতে খরচ বেশী হয়েছে এবং সেগুলো একটু চেষ্টা করলেই কমানো সম্ভব কিনা!
শপিং এ যাবার আগে লিস্ট করুন
শপিং এ যাবার আগে লিস্ট করুন। জামা কাপড় কেনার আগে দেখে নিন আপনার কি কি আছে এবং কি কি আসলেই কেনা প্রয়োজন।
লক্ষ্য ঠিক করুন
ভবিষ্যতে আপনার বিগ বাজেটের কি কি কিনতে হবে সেটার একটা তালিকা করে সময়সীমাও নির্ধারণ করুন। যেমন, ৫ বছর পর ফ্ল্যাট, ১ বছর পর টিভি আর এক মাস পর ওভেন। এভাবে ঠিক করে কত টাকা করে জমালে এই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব, সেটি খেয়াল রাখুন ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিন।