বেশির ভাগ দেশে বিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ। বাগদান (এনগেজমেন্ট) বিবাহ-পূর্ব একটি শুভ অনুষ্ঠান, যে অনুষ্ঠানে বাগদানের অঙ্গুরি বাঁ বা ডান হাতের অনামিকায় পরা হয়।
‘আংটি বলিল শোন হে অনামিকা
তোমার সৌন্দর্য ত সবই মোর দান।’
বাঁ হাতের অনামিকায় আংটি মানে বিয়ের লক্ষণ। নিদেনপক্ষে বাগদান হয়ে গেছে বোঝা যায়। অনামিকাকে আমরা বলি রিং ফিঙ্গার। অন্য আঙুল কেন নয়?
বিয়ের আংটি পরার চল প্রাচীন মিসর থেকে। বলা হয়, প্রাচীন প্যাপিরাসে আছে, মমিদের ওপর পাওয়া গেছে বাঁশের বিচিত্র বুননিতে তৈরি রিং। মনে করা হয়, এর দ্বারা আত্মার সঙ্গে পরবর্তী গন্তব্যের যোগাযোগ হয় বিবাহিত দম্পতির। তবে এর সঙ্গে আংটির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। এর আকৃতি গোলাকার বা বলয়ের মতো হয়, যা তাঁদের নিয়ে যায় অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে।
হায়ারোগ্লিফিকস থেকে দেখা যায়, সে সময় কনেদের আঙুলে থাকত একটি করে আংটি। চিরন্তন ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে তাঁদের বিয়ের আংটি পরা শুরু হয়। তখন এমন বিশ্বাস ছিল, অনামিকা থেকে এক স্পর্শকাতর স্নায়ু চলে গেছে হৃদয়ে। হৃদযন্ত্র রক্ত সংবহনের অঙ্গ হলেও একসময় মনে করা হতো হৃদয় হলো অনুভূতির কেন্দ্র।
গ্রিক আর রোমান সভ্যতায় দেখা যায়, বাঁ হাতের অনামিকায় আংটি পরার প্রচলন। তাঁদের বিশ্বাস, একটি ভেনা আমোরি ( লাতিন শব্দ, যার অর্থ ভালোবাসার আংটি) আঙুল থেকে সরাসরি যায় হৃৎপিণ্ডে। রোমান আমলে আঙুলের তেমন নির্দেশক ছিল বাবা, পুত্র, হলি, ঘোস্ট আর আমেন। আর রিং পরা হবে আমেন যেটি, সেটিতে।
কিন্তু সেই বিশেষ ধমনি বা স্নায়ু কি আছে? সরাসরি বলা যায়, নেই। তবু এমন একটি ধারণা ছিল তখন। বাঁ হাতের অনামিকায় আংটি পরিয়ে ভালোবাসাকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা থেকে। ডান হাতে আংটি পরার চল ডেনমার্ক, পোল্যান্ড আর কিউবায়। জার্মানি আর অস্ট্রিয়াতেও সেই ধারা।
দুটি প্রেমময় হৃদয়ের মিলন হয় গোলাকার আংটির রূপ ধরে। কেন গোলাকার? গোল দিয়ে মূলত বোঝানো হয় শাশ্বত, চিরন্তন। বৃত্তের বলয়ের নেই কোনো প্রান্ত, অসীম এর যাত্রা। ভালোবাসাও মানে না কোনো প্রান্ত। তবে ধমনির এই তত্ত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।বিজ্ঞাপন
ষোড়শ শতাব্দীতে একজন ডাচ চিকিৎসক লেভিনাস লেমনিয়াস তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘যদি কোনো নারী একটি সোনার আংটি অনামিকায় ঘষতে থাকেন, তাতে তাঁর হৃদয়ে এক মৃদু আলোড়নের সৃষ্টি হয়। তাঁর দেহ-মন সতেজ হয়।’ তবে এই ব্যাখ্যারও খুব প্রামাণিক সত্যতা নেই।
ইসরায়েলে আরেক রকম প্রচলন বিয়ের আংটির। তাঁরা ডান তর্জনীতে বিয়ের আংটি পরেন। মনে করেন বিয়ের আংটি এই আঙুলেই পরাতে হবে। চীন দেশের মানুষের বিয়ের আংটি নিয়ে আছে অন্য ব্যাখ্যা। আকুপাংচারবিদদের মতে, তাঁদের বিশ্বাস, হাতের পাঁচ আঙুল আমাদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের নির্দেশক। বুড়ো আঙুল মা-বাবার প্রতিনিধিত্ব করে, তর্জনী করে সন্তানদের প্রতিনিধিত্ব, মধ্যমা নিজেকে আর অনামিকা জীবনসঙ্গীর। কনিষ্ঠায় বোঝায় নাতি-নাতনি।
তাঁরা বলেন, আপনি যদি হাত দুটো প্রার্থনার ভঙ্গিতে আনেন আর মধ্যের আঙুলগুলো একত্র করেন, এরপর আপনি সব আঙুল বিচ্ছিন্ন করতে পারলেও রিং ফিঙ্গার আলাদা করতে পারবেন না। এ দিয়ে বোঝা গেল, আমাদের বাগদত্তার সঙ্গে আমরা আর বিচ্ছিন্ন হব না।
ইহুদিমতে রিং থাকবে বরের কাছে, যা কঠিন ধাতু আর রত্নখচিত হবে না। অনেকে আবার প্রচলিত ধারণার বাইরে যান, যেমন প্রিন্সেস ডায়ানা পরেছিলেন রঙিন রত্নের আংটি, অনেকে পরেন নীলকান্তমণি।
অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে চল আছে বাগদান আর বিয়ের আংটি অনামিকায় পরার। বাগদানের আংটি ডান হাতে আর বিয়ের আংটি বাঁ হাতে পরেন তাঁরা। অনামিকা সম্পর্কে জ্যোতিষশাস্ত্রে আছে ব্যাখ্যা—প্রেম স্বর্গীয়, যা সবার মধ্যে থাকতে পারে। রবির আঙুল অনামিকা আর তাই প্রেমের আঙুলও। বহুকাল ধরে বাঁ হাতের অনামিকায় পরানো হয় আংটি, নারীকে তাই বলা হয় বামা।
সব না হয় গেল, আংটি পরার কি কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে? টেলিভিশন উপস্থাপক জিমি ফেলন আংটি পরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। আঙুলে জোর দিয়ে আংটি গলাতে গিয়ে পড়েছিলেন বিপত্তিতে। সাধারণত আমরা দেখি, গয়নার দোকানে কর্মীরা অনেক দক্ষ থাকেন এ বিষয়ে। তাঁরা কৌশলে আংটি গলিয়ে দেন অনামিকায়। সাবান দিয়ে পিচ্ছিল করেও পরা যায়। খুব জোরে আংটি আঙুলে ঢোকালে সেখানের মাংস বা টিস্যু আহত হতে পারে। যেমন জিমি ফেলনকে শেষমেশ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়েছিল, করতে হয়েছিল ‘মাইক্রো সার্জারি’।
খেলাধুলার সময়ও আংটি পরা ঠিক নয়। বাচ্চারা খেলার সময় আংটি পরবে না। আঙুলে আংটি পরা ও খোলার সময় সাবধান থাকতে হবে। এক্স-রে করাতে গেলে বা কোনো চিকিৎসাযন্ত্রের কাছে গেলে আংটি খুলে যান।
অনেকের হয় ওয়েডিং রিং ডারমাটাইটিস। আংটি পরে চামড়ার এমন রোগ হতে পারে, যাতে ধাতুবলয়ের সঙ্গে অনবরত ঘষায় ফুসকুড়ি উঠতে পারে। বলয়ের ধাতুতে অ্যালার্জিও হতে পারে। তবে সব সময় স্বাস্থ্যবিধি মানলে আর পরিচ্ছন্ন থাকলে সেই আশঙ্কা কমে যায়।
যাঁদের চর্মরোগ আছে, হাতে আংটি পরলে নিয়মিত পরিষ্কার করে নেবেন। হাত ধুলে আংটি খুলে শুকিয়ে পরবেন। তবে এসব জেনে বিয়ের ‘আংটি পরবেন না’-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই। ভালোবাসা আর আঙুল দুটোরই সুরক্ষা প্রয়োজন হয়। তাই আংটি থেকে আঘাত পাওয়া এড়াতে কী ব্যবস্থা নিতে পারেন?
- আঙুল যখন ঝুঁকিতে থাকতে পারে, তখন রিং খুলে রাখুন। যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছেন, এমন শ্রমিক, খেলোয়াড় (বিশেষ করে বাস্কেটবল খেলোয়াড়), যাঁদের হতে পারে রিং এভালসন। আঘাতে বিচ্ছিন্ন হতে পারে আঙুলের রিং, ভেঙে যেতে পারে আঙুল। তাই আগেই রিং খুলে নিন।
- অনেকে সিলিকন রিং পরার কথা বলেন।
- খুব আঁটসাঁট রিং পরবেন না। এমন অনেক রোগী পাওয়া যায়, যাঁরা বহু বছর ধরে একই রিং পরে আছেন, কখনো খোলেননি। এমন ক্ষেত্রে অনেকের রিং কেটে বের করতে হয়। যাঁরা পর্বতারোহী, তাঁদের আংটি না পরাই ভালো।
তবে সবকিছু এড়ানো যাবে সাবধান থাকলে। তাই সাবধান থেকে আনন্দের সঙ্গে পরুন বিয়ের আংটি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটি আংটি উপহার দেন লেডি রানু মুখোপাধ্যায়কে। তিনি সানন্দে সেই আংটি পরেছিলেন অনামিকায়। কিন্তু পরে তা গেল চুরি। অবশ্য উদ্ধারও হয়েছিল তা, সে গল্প এখানে নয়। তবে বহুমূল্য আংটি খুলে এমন স্থানে রাখবেন না, যেখান থেকে তা আপনার হাতছাড়া হতে পারে।
পছন্দের মানুষকে ভালোবাসা জানাতে পরাতে পারেন আংটি কিন্তু সাবধানে। নাজুক, কোমল হাতে পরান ভালোবাসার নিদর্শন।