পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বিশেষ কোনো অঞ্চলে নতুন সম্প্রদায় প্রবেশের সাথে সাথে সেই অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়ে নানা পরিবর্তন ঘটে। এই ব্যাপারটি ঘটেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও। ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পরিবর্তন সাধন হতে থাকে নানা দিকে। মুসলমানদের কারণে শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সংগীত এবং স্থাপত্যে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি পরিবর্তন আসে অলংকার শিল্পেও। মুঘলরা শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চারু ও কারুশিল্পের উন্নয়নেও সচেষ্ট হন। মুঘল শাসকগণ তাদের ধর্ম ও সম্পদ শিল্পের উন্নয়নের কাজে লাগিয়েছিলেন। তারা শিল্পীর দক্ষতা অর্জন, অর্জিত দক্ষতাকে কাজে লাগানো, অভিজ্ঞতা ও প্রতিভা প্রকাশের ক্ষেত্রে সব ধরনের সাহায্য করতেন। ফলে মুঘল আমলের অলংকারের নকশায় সৌন্দর্য বিষয়ক উত্কর্ষতা, কারিগরী দক্ষতা এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজের প্রতি কারিগরদের আগ্রহ জন্ম নিয়েছিল।
মুঘল আমলে অলংকার শিল্পে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুঘল মিনিয়েচারে ব্যবহৃত অলংকারের মাধ্যমে। ১৬৩০ সালে আঁকা প্রিন্স সেলিমের একটি চিত্রে দেখা যায় তিনি কানে, গলায়, হাতে এবং পাগড়ীতে মুক্তার অলংকার ব্যবহার করেছেন। আরেকটি চিত্রে দেখা যায় সম্রাট শাহজাহানের তিন পুত্র শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব এবং মুরাদ ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বের হয়েছেন। তাদের হাতে, গলায়, কানে ও কোমরে নানান অলংকার দেখা যায়। অনেকের ধারণা ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় প্রচলিত অলংকারের রূপ বদলের তেমন একটা চেষ্টা করেনি। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে রূপ বদলের প্রচেষ্টা যে হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান এক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখেন। কানের যে ঝুমকা ব্যবহারের প্রচলন দেখা যায় সেই ঝুমকা এবং কানফুল নিয়ে তিনি চিন্তা করেছেন এবং দুটো একত্রে যুক্ত করে একটি অনন্য রূপ দিয়েছেন। সুতরাং কানফুল বা কর্ণঝুমকা যে নূরজাহান তথা মুঘলদেরই তৈরি, তা বোঝা যায়। মুঘল রমণীরা নানা ধরনের আকর্ষণীয় অলংকার পরতেন। যেমন –
সারপাঞ্চ : এটি টুপি বা পাগড়ীর এক পাশে পরা হতো। মুঘল আমলে সারপাঞ্চ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য হতো।
ঝাপটা : নারীরা মাথার এক পাশের চুলে ঝাপটা পরতেন। এর কিছু অংশ কপালের এক পাশে ঝুলে থাকত।
টিকা : এটি মাথার সিঁথিতে পরা হতো। মাথার অংশে থাকত চেইন এবং নিচের অংশটি অনেকটা লকেটের মতো হতো।
বান্দিবিনা : এটি মাথার চুলের বেণীতে বা খোঁপাতে পরা হতো।
নাকের অলংকার : নাকে নথ, নাকফুল ও বুলক পরতেন মুঘল রমণীরা।
বালি : এটি কানে পরার জন্য রিংয়ের মতো দুল।
কর্ণফুল : এটি ফুলের আকৃতির কানের অলংকার। দণ্ডের ওপর নানা আকৃতির ফুলের নকশা করা হতো।
ঝুমকা : ঘণ্টার মতো দেখতে। অনেক সময় কর্ণফুলের সাথে সংযুক্ত থাকত।
কানপাতা : কানপাতা তৈরি হতো পুরো কানের আদলে। এটি সম্পূর্ণ কান ঢেকে রাখত।
মোর-ভানওয়ার : কানের এই অলংকারটি তৈরি হতো ময়ূরের আকৃতিতে।
মাছলি : এটি মাছের আকৃতিতে তৈরি কানের অলংকার।
বিছা : মোঘল রমণীরা কোমরে বিভিন্ন ধরনের বিছা পরতেন।
চন্দ্রহার : কোমরের এই অলংকারটি অনেকটা বিছার মতো। এতে একাধিক চেইন থাকত এবং চাঁদ, তারা, ঘণ্টা ইত্যাদি আকৃতির লকেট এতে ঝুলতে থাকত।
গুলুব্যান্ড : গলাকে বেষ্টন করে রাখা এক ধরনের অলংকার। এটি ভেলভেট কাপড় ও মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি হতো।
চিক : এটা দেখতে অনেকটা গুলুব্যান্ডের মতোই। তবে পুরোটাই সোনার তৈরি এবং সাথে টার্সেল লাগানো থাকত।
হাঁসুলি : অর্ধচন্দ্রের আকৃতিতে তৈরি হতো এই গলার অলংকার।
সাতলহরা : এই অলংকারে সাতটি ধাপ তৈরি করা হতো মুক্তা বা সোনার সাহায্যে
হাইকাল : নয়টি ধাতবখণ্ড মিলিয়ে এই গলার অলংকারটি তৈরি করা হতো।
মোহনমালা : এটি সোনার তৈরি গোলাকার পুঁতি দিয়ে বানানো গলার অলংকার।
ইতরাদান : চারকোনা আকৃতির সোনা বা পাথরের তৈরি লকেটযুক্ত গলার অলংকার। এই লকেট সিল্কের দড়ি বা টার্সেলের সাথে যুক্ত থাকত।
চম্পাকলি : এটি চম্পা ফুলের কলির আদলে তৈরি গলার অলংকার।
বাজুবান্ধ : এটি বাহুর উপরের অংশে পরা হতো।
জওসান : সিলিন্ডারের মতো ছয়টি লম্বা অংশ দিয়ে তৈরি হাতের অলংকার।
তাগা : এটা পুরোপুরি সোনা বা রূপার তৈরি ব্রেসলেটের মতো অলংকার।
চূড় : বিভিন্ন মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি চূড় হাতে পরতেন মোঘল রমণীরা।
কারহা : এটি হাতের অলংকার। কারহা মূলত এক ধরনের বালা।
মানতাশা : সোনা ও মূল্যবান পাথরের তৈরি হাতের অলংকার।
আরো পড়ুন
- ওয়ানডে ম্যাচের ইতিহাসে বাংলাদেশের সেঞ্চুরিয়ান প্রথম নারী ফারজানা
- দেশের প্রথম নারী প্যারা কমান্ডো জান্নাতুল ফেরদৌস
- কেন এখন বিয়ের উপহার (Marriage Gift) উপহার হিসেবে নগদ টাকাই বেশি প্রত্যাশিত !!
- স্বাস্থ্যকর নখ (Nails) বজায় রাখার টিপস
- লিপস্টিক এর আবিষ্কার
গাররাহ্ : রেশমী কাপড়ের ওপর চারকোনা ধাতবখণ্ড বসিয়ে হাতের এই অলংকারটি তৈরি হতো।
রতনচূড় : ব্রেসলেট বা চুড়ির সাথে চেইনের সাহায্যে সংযুক্ত থাকত পাঁচ আঙুলের পাঁচটি আংটি।
আরসি : বুড়ো আঙুলে পরার আংটি। এতে পাথরের পরিবর্তে আয়না ব্যবহৃত হতো।
ছাল্লা : সাদামাটা সোনার আংটি।
আংগুষ্ঠার : এটি সোনার তৈরি মূল্যবান পাথর সম্বলিত আংটি।
শাহলামী : ডিম্বাকার আকৃতির এক ধরনের আংটি।
আনওয়ার : এটি পায়ের আঙুলে পরার আংটি।
ঘুঙরু : ছোট ছোট ঘণ্টাযুক্ত পায়ের অলংকার।
পেহজিব : ধাতুর মোটা তার দিয়ে তৈরি পায়ের অলংকার। তেহজিবেও ঘণ্টা সংযুক্ত থাকে।
ঝানঝার : মোঘল আমলের বেশ জনপ্রিয় একটি পায়ের অলংকার।
চারহা : অনেকগুলো চিকন চুড়ির মতো রিংযুক্ত পায়ের অলংকার। হাঁটার সময় রিংগুলোতে শব্দ সৃষ্টি হতো।
বর্তমান অলংকার শিল্পে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে মুঘল আমলের। বিশেষ করে বিয়ের গয়না এখনো মুঘল ডিজাইনেই তৈরি হয় বেশি।