You are currently viewing গহনার ইতিহাস

প্রথমে এটা ছিল তামার একটি পিণ্ড। সেটাকে প্রথমে ঠাণ্ডা অবস্থায় হাঁতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পাতে পরিণত করা হয়। এরপর কাটা হয় বাটালি দিয়ে। সবশেষে দেওয়া হয় পুঁতির আকার। আর এটাই হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম অলঙ্কার।

সম্ভবত এটি ব্যবহৃত হত মাদুলি হিসেবে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৬ হাজার ৫শ বছর আগের তো হবেই। পাওয়া গেছে পাকিস্তানের মেহেরগড়ে প্রাক-মৃৎশিল্পের স্তর থেকে।

এত আগের এই অলঙ্কার পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রাচীন ভারতীয় সমাজে চারটি জিনিস সবচেয়ে দামি মনে করা হত। সেগুলো হচ্ছে— গরু, ঘোড়া, হাতি এবং অলঙ্কার। আর ভারতে অলঙ্কার শিল্পের বিস্তার লাভ করেছিল যতটা না নিজেকে সাজানো বা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বোঝানোর জন্য তার চেয়ে বেশি চিকিৎসার প্রয়োজনে।

১৭৮৯ সালে ফ্র্যানচেসকো রেনাল্ডির আঁকা ঢাকার এক মুসলিম তরুণীর ছবি। তার পরে থাকা অলঙ্কারসমূহ বেশ দর্শনীয়।

ভিন্ন ভিন্ন রত্ন পরলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে— মূলত এই বিশ্বাস থেকেই অলঙ্কার শিল্পের প্রসার। রত্নকে কোনো অলঙ্কারের মধ্যে বা সঙ্গে সংযুক্ত করে পরা হত। আর এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে অলঙ্কারের যাত্রা।

অলঙ্কারের মধ্যে সোনা বা স্বর্ণ স্থান করে নিতে বেশ সময় নেয়। তবে ঠিক কতটা সময় পর তা বলা যায় না। সবচেয়ে পুরানো স্বর্ণের তৈরি অলঙ্কারটি পাওয়া যায় পাকিস্তানের জালিপুরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩ হাজার ৫শ’ সালে। সিন্ধু উপত্যকায় বিশেষ করে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় স্বর্ণালঙ্কারের বহু ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে।

আর দক্ষিণে সোনা বহনকারী বালু থেকে।

সে সময় বিপুল পরিমাণে ভালোমানের সোনা পাওয়া যেত গঙ্গার সঞ্চিত পলিমাটির স্তূপ থেকে।



আরো পড়ুন



তবে বাংলাদেশে অলঙ্কারের নমুনা পাওয়া যায় মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত মৃৎফলকে উৎকীর্ণ অলঙ্কার থেকে। সে সবের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় এবং প্রথম শতক। শুধু স্বর্ণের অলঙ্কারই নয়, আরও পাওয়া গেছে তামার বালা ও আংটি। সেগুলোর নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতক।

লেখ্য ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয়, এ অঞ্চলে অলঙ্কারের ব্যবহার ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৯৬ সালে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পুন্ড্র (বগুড়া) এবং ত্রিপুরায় (কুমিল্লা) রুপা ব্যবহারের কথা জানা যায়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে এমন একটি সোনার ভাঙা বাজু আছে যা পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ সালের বলে মনে হয়।

মোদ্দা কথা হচ্ছে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের সমান্তরালে অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও অলঙ্কার শিল্পের ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিল।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম অলঙ্কার বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের পাশাপাশি পাওয়া গেছে নরসিংদীর ওয়ারির বটেশ্বরে। এখানে অলঙ্কারগুলোর মূল্যমান কম। কম দামি পাথরের পুঁতি। যা খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ থেকে ৩৭০ বছর আগের। ওয়ারি বটেশ্বরে এই ধরনের অলঙ্কার পাওয়াও গেছে বেশ।

তাছাড়া বাংলাদেশে আবিষ্কৃত গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার ভিত্তিতে বলা যায় যে গুপ্ত শাসনামলে (আনুমানিক ৩২০ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব) এখানে স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন ছিল। সেসময় নারী-পুরুষরা শরীরের উপরের অংশে কোনো পোশাক পড়তেন না। ধনীরা নানা রকম অলঙ্কার দিয়ে সে অংশটি ঢেকে রাখতেন।

১২০৫ সালে বাংলায় সুলতানি আমল শুরু হয়। মুসলমান শাসকদের হাত ধরে বাংলায় মুসলিম ঘরানার অলঙ্কারের চল হয়। তৎকালীন সাহিত্যে এখানে সোনা ও রুপার অলঙ্কারের ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়।

নারীরা সুন্দর পোশাক ও মূল্যবান অলঙ্কারাদি পড়তে খুব ভালোবাসতেন। পনের শতকে শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত ‘ইউসুফ-জুলেখা’য় সেই চিত্রই পাওয়া যায়। শাহ মুহম্মদ সগীর ছিলেন গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের (১৩৮৯ থেকে ১৪১০) সভাকবি। এতে হজরত ইউসুফ (আ:) আর জুলেখার প্রেমকাহিনী হলেও এতে কবি বাংলার উপাদান ব্যবহার করেছেন।  

দেখা যায় সম্পশালী পরিবারের মেয়েরা গলার হার, মুক্তা ও হীরার কর্ণকুণ্ডল, অনন্ত, বালা এবং মূল্যবান পাথর বসানো সোনার আংটি ব্যবহার করে থাকত। শুধু সাহিত্যেই নয়, মধ্যযুগে বাংলায় আসা বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণকাহিনী থেকে এখানকার অলঙ্কারের কথা জানা যায়।

১৪১৪ সালে (সে সময় বাংলার শাসক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ) সোনারগাঁয়ে এসেছিলেন চীনা পর্যটক মা হুয়েন। তিনি বাংলার কারুশিল্পীদের তৈরি বেশ কিছু অলঙ্কারের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন— কর্ণকুণ্ডল, কেয়ূর, শঙ্খবলয়, মেখলা।

আঠারো শতকের শেষের দিকে ব্যালথাজার সুলভিনসের আঁকা সম্ভ্রান্ত বাঙালি নারীর ছবি। তার গলা আর হাতে পরে থাকা অলঙ্কারগুলো বেশ লক্ষনীয়।

বাংলার নারীরা কী ধরনের অলঙ্কার পরতেন সেসব উল্লেখ করতেও ভুল করেননি মা হুয়েন। ‘তাঁদের কানে প্রস্তর খচিত সোনার কর্ণাভরণ, গলায় মালা, মণিবন্ধ ও বাজুতে সোনার গহনা।’

এ বর্ণনা অনুযায়ী মনে হয় কিছুটা অবস্থাপন্ন ঘরের নারীরাই এসব অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। কেননা একই সঙ্গে হুয়েন বলেছেন, ‘ঘরের বউঝিদের জন্য ছিল কচি তালপাতার দুল। আর তখনকার রাজকীয় মানমর্যাদার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নানা রকমের মূল্যবান রত্ন। সুলতান ব্যবহার করতেন মুক্তা, নীলকান্ত মণি, মরকত, মণি, প্রবাল প্রভৃতি। শুধু নিজের ব্যবহারই নয়, অন্যান্য দেশের রাজাদের কাছেও তিনি উপহার হিসেবে মূল্যবান মণিমুক্তা পাঠাতেন।’

হুয়েনের ঠিক ১০০ বছর পর ১৫১৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্তে বারাবোসা। তিনি বাংলায় সোনা, রুপার ব্যবসার কথা বলেছিলেন। মালাক্কার তুলনায় বাংলায় সোনার দাম ছয় ভাগের এক ভাগ বেশি হওয়ায় এবং বাংলা থেকে মালাক্কায় রুপা নিয়ে গেলে তার দাম চার ভাগের এক ভাগ বেশি হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীরা সোনা-রুপার ব্যবসায় বেশি আগ্রহী হতেন। তখনকার অভিজাত মুসলমানদের অলঙ্কার ব্যবহারের কথা বলেন এই পর্তুগিজ পর্যটক।

পুরুষদের একাধিক আঙুলে থাকত সোনার আংটি। তাঁদের ছুরির বাঁট ও খাঁপেও থাকতো রুপার বাজু। আর নারীরাও ব্যবহার করতেন সোনার অলঙ্কার। এগুলো ছিল বাংলার অভিজাত শ্রেণির অলঙ্কারের ব্যবহারের কথা।

১৫৬৭ সালে ইটালির পযর্টক এসেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে। তিনি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম হচ্ছে সমস্ত বাংলাদেশের (সম্ভবত পূর্ব বাংলার কথা বলা হয়েছে) রুপার প্রধান কেন্দ্র। এই বন্দর মূলত বাংলায় রুপার আমদানির কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

তবে গ্রামীণ বাংলার মানুষদের অলঙ্কারের বর্ণনা পাওয়া যায় ইংরেজ বণিক র‌্যালফ ফিচের কাছ থেকে। এই ভদ্রলোক সম্ভবত ১৫৮৬ সালের দিকে চট্টগ্রাম হয়ে বরিশাল আসেন। সেখানকার মেয়েদের অলঙ্কারের কিছু বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। মেয়েরা গলায় হাঁসুলি, হাতে বালা, পায়ে তামা এবং হাতির দাঁতের তৈরি মল পরত। এটা ছিল মধ্যবিত্ত মেয়েদের ব্যবহার করা অলঙ্কারের বর্ণনা। আর ধনীদের অলঙ্কারের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, এরা গলায় আর বাহুতে নানান ধরনের রুপার গহনা পরে থাকে। পায়ের আঙ্গুলেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা থাকতো রুপা, তামা এবং হাতির দাঁতের আংটি।

মোগলাই ঝুমুর, উনিশ শতকের।

বাংলার ক্ষমতা মোগলদের কাছে চলে যাওয়ার পর এই অঞ্চলের অলঙ্কারের ভেতর ধীরে ধীরে ইসলামি বা বিশেষ করে বললে পারস্যরীতি প্রবেশ করা শুরু করে। মোগলদের অলঙ্কারের পরিবর্তনে বিশেষ অবদান রেখেছেন মোগল জেনানা মহল। সম্রাজ্ঞী থেকে রাজকুমারীরা নিজের পোশাকের পাশাপাশি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেন অংলকার। বিশেষ কোনো পাথর পেলে সেটাও সংযোজন করত নিজের অলঙ্কারে।

মোগল নারীদের নাকে, কানে থাকতো মুক্তা দিয়ে তৈরি করা নানারকম অলঙ্কার। মোগল নারীদের পরে থাকা অলঙ্কার দিয়ে তাঁর স্বামী অথবা বাবার রাজকীয় পদ সর্ম্পকে একটা ধারণা পাওয়া যেত। অর্থ্যাৎ যে নারীর স্বামী অথবা বাবা যত বেশি উচ্চপদে থাকতেন তিনি ততোবেশি অলঙ্কার পড়ে থাকতেন।

মোগল রাজপুরুষরাও অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। তাদের ছয় থেকে আট সেট মূল্যবান রত্নবাসানো অলঙ্কার থাকতো। গলায় কয়েক প্যাঁচ দিয়ে পরতেন মুক্তার মালা। যা দিয়ে দুই কাধ পর্যন্ত ঢেকে যেত। পাগড়ির মাঝখানে থাকতো একটা বড় রত্ন। অনেক সময় পাগড়ির চারদিকেও গোল করে নানারকম দামি রত্ন ব্যবহার করা হত।

কখনও কখনও মোগল রাজপুরুষরাও কানে দুল পরতেন। তবে সেটা নারীদের মতো ঝুলে থাকতো না। বাংলার নবাব আলীবর্দী খানকে একটি ছবিতে কানে দুল পরে থাকতে দেখা যায়। তবে সবসময় দুল পরে থাকতেন এইসব রাজপুরুষরা। সম্ভবত কখনও কখনও ফ্যাশন করে তা পরা হয়ে থাকত। আর কম বয়সি মোগল পুরুষরাই কানে দুল পরতেন।

শুধু মোগল যুবরাজ কিংবা রাজকুমারীরাই নয় মোগল সুবাদাররাও (গভর্নর) সম্রাটদের মতো দামি রত্ন কদর করতেন আর সংগ্রহ করতেন। বিজিত রাজ্যে থেকে সংগ্রহ করা সেরা রত্নটি পাঠিয়ে দিতেন মোগল সম্রাটের কাছে। এভাবে সম্রাটদের খুশি রাখতেন সুবাদাররা। ১৬৬৩ সালে ঢাকা এসেছিলেন ফ্রান্সের হীরা ব্যবসায়ী জঁ বাঁতিস্তা তাভের্নিয়ার। তার কাছ থেকে বেশ দাম দিয়ে হীরে-জহরত সংগ্রহ করেন সেসময়কার ঢাকার সুবাদার শায়েস্তা খান।

প্রায় সাড়ে তিনশত বছর ধরে মোগলদের অধীন থাকায় ভারতীয়রা মোগলরীতি গ্রহণ করেছিল। ফলে অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও মোগলদের মতো করে অলঙ্কার পরতে শুরু করে। এরপর ভারতবর্ষের ক্ষমতা যখন ইংরেজদের হাতে গেল তখন হুট করেই যে বাংলার অলঙ্কারে পরিবর্তন আসা শুরু করল তা কিন্ত নয়।

উনিশ শতকের শেষ দিকেও পুরুষদের অল্প করে হলেও অলঙ্কার ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে সেসব অনেকটা আনুষ্ঠানিক হয়ে পড়ে। যেমন— বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অলঙ্কার পরতে দেখা যায়।

তবে নারীরা ইংরেজি ছাপ থেকে ছিলেন মুক্ত। তাদের অলঙ্কার ব্যবহারে মোটা দাগে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। বলা যায় এটা কোনোরকমে টিকে ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত।

এরপর ধীরে ধীরে অলঙ্কারে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। অলঙ্কার বলতে এখন শুধু স্বর্ণ আর দামি রত্ন দিয়ে তৈরি কোনো গহনা বুঝায় না। বাঙালি নারীরা এখন ইমিটিশনের অলঙ্কার থেকে শুরু করে প্লাস্টিক, মাটির অলঙ্কারও ব্যবহার করে থাকেন। ভারি ভারি অলঙ্কার পরাটায় এখন কোনো ‘স্মার্টনেস’ খুঁজে পান না আধুনিকারা।   

Leave a Reply