শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ (Match) ড্র করার কৃতিত্ব দেখাল বাংলাদেশের মেয়েরা। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ফারজানা হক পিংকির সেঞ্চুরিতে ভর করে ৪ উইকেটে ২২৫ রান তোলে বাংলাদেশ। এদিন তিন অংক ছুঁয়েই ইতিহাস গড়েন ৩০ বছর বয়সী ফারজানা। এর আগে ৫৬ ওয়ানডে ম্যাচ (Match )ইতিহাসে বাংলাদেশের কেউ সেঞ্চুরি করতে পারেননি। সবার আগে এ কীর্তিটা গড়লেন ফারজানা। পরে রান তাড়া করতে নামা ভারতকে ২২৫ রানে অলআউট করেন স্বাগতিক দলের বোলাররা।
মেহরাব হোসেন অপি, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, তামিম ইকবাল..এই তালিকায় ঢুকে গেলেন ফারজানা হক পিঙ্কিও। মেহরাব, আমিনুল, তামিম যথাক্রমে ওয়ানডে, টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান।
ফারজানা হক পিঙ্কি শনিবার ভারতের বিপক্ষে ১০৭ রানের ইনিংস খেলে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে করেছেন শতরান। নিজের ৫৩তম ওয়ানডে ইনিংসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দেখা পেলেন ফারজানা।
বৃষ্টিতে ওয়ানডে ম্যাচ(Match) এ সময় নষ্ট হওয়ায় সুপার ওভারের কোনো সুযোগও ছিল না। ফলে ওয়ানডে ম্যাচ(Match) এটাই হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। এতে তিন ম্যাচ সিরিজটা ১-১-এ সমতায় থাকল। ট্রফি ভাগাভাগি করে দুই দল।
নাটকীয় ওয়ানডে ম্যাচ (Match)এ রান তাড়া করতে নেমে ৩২ রানে ২ উইকেট হারায় ভারত। এরপর স্মৃতি মন্ধানা (৫৯) ও হারলিন দেওলের (৭৭) ব্যাটে ভর করে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করে অতিথিরা। দুজন ১৪২ বলে ১০৭ রান যোগ করেন বোর্ডে। এতে একটি পর্যায়ে ৪১.১ ওভারে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৯১/৪। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ম্যাচ (Match) তারা জিততে পারেনি। শেষ ৩৪ রানে পড়েছে সফরকারী দলের ৬ উইকেট।
শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে কাল শেষ মুহূর্তে হয়েছে রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা। তিন উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ১৮ বলে মাত্র ১০ রানের প্রয়োজন ছিল ভারতের। ৪৮তম ওভারে সহঅধিনায়ক নাহিদা আক্তার ঘূর্ণি বলে স্নেহ রানা ও দেবিকা বৈদ্যকে সাজঘরে ফেরালে ম্যাচ(Match) ফেরে বাংলাদেশ (২১৭/৯)।
প্রায় এক দশক আগে, ভারতের বিপক্ষেই আহমেদাবাদে অপরাজিত ৭৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সালমা খাতুন, এতদিন সেটাই ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ নারী দলের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ফারজানা এর আগে নয়টা হাফসেঞ্চুরি করলেও সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল ৭১ রানের, করেছিলেন গত বছর হ্যামিলটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচে। শনিবার নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন ফারজানা, গড়লেন ইতিহাস। প্রথম ম্যাচ(Match) এ ফারজানা নেমেছিলেন ওয়ান ডাউনে,করেছিলেন ২৭ রান। পরের ম্যাচ(Match) এ ও ওয়ান ডাউনে, করেছেন ৪৭ রান।
ভারতের বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে ভালোই করছিলেন ফারজানা, কিন্তু ইনিংসটা বড় হচ্ছিল না। আগের ম্যাচেও রিতু মনিকে সঙ্গে নিয়ে ফারজানা যখন ব্যাট করছিলেন, তখন জয়ের সম্ভাবনা দেখছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তাদের বিদায়ে তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার।
তৃতীয় ওয়ানডের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কান কোচ হাশান তিলকারত্নে বলেছিলেন, বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের ‘‘মানসিকতা বড় ইনিংস খেলার জন্য প্রস্তুত নয়।এছাড়া ফিটনেসও গড়পড়তার নীচে” – সেটাই কি তাতিয়ে দিলো ফারজানাকে?
প্রথম দুই ম্যাচ শেষে সিরিজ ১-১ সমতায়, তাই শেষ ম্যাচ জয়ী দলই জিতবে সিরিজ। শেষ ম্যাচে ফারজানা নেমেছfnsন ইনিংসের সূচনায়, সঙ্গে ছিলেন সিরিজে এই ম্যাচেই প্রথম দলে সুযোগ পাওয়া শামীমা । দুজনে মিলে শুরুটা করেছেন ধীরস্থির, সাবধানী। প্রথম পাওয়ার প্লে’র ১০ ওভারে দলের রান মাত্র ৩২, তবে কোনো উইকেট না হারিয়ে। অল্পের জন্য হয়নি শতরানের উদ্বোধনী জুটি, ফারজানাকে রেখে বিদায় নেন হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেয়া শামীমা (৫২)। তাতে দমে যাননি ফারজানা, অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতিকে নিয়ে ৮৫ বলে ৭১ রানের জুটি গড়ে দলের সংগ্রহকে বাড়িয়ে নেয়ার পাশাপাশি নিজেও এগিয়ে যান শতরানের দিকে।
৮২ থেকে ৯০ এর ঘরে পৌঁছে যান দ্রুতই, মেঘনা সিংয়ের ওভারে দুটো ডাবলসের পর দুটো বাউন্ডারি হাঁকিয়ে। ১০০ রান থেকে যখন মাত্র ৬ রান দূরে, তখন খানিকটা ছটফটে। একবার রানআউটের হাত থেকেও বেঁচেছেন। শেফালি ভার্মার বলে দ্রুত ১ রান নিতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, ডাইভ দিয়ে উইকেটে পৌঁছালেও ফিজিওর শরণ নিতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শেফালি ভার্মার বলে কভার দিয়ে চার মেরে সেঞ্চুরি করেনফারজানা। ১৫৬ বল খেলেছেন সেঞ্চুরি করতে, চার মেরেছেন ৭টি। ইনিংসের শেষ বলে রান আউট হয়েছেন ফারজানা, না হলে ইনিংসে আদ্যান্ত ব্যাট করার রেকর্ডও করতে পারতেন। শুধু শতরানের হিসেবেই নয়, বল খেলার হিসেবেও ফারজানার ইনিংসটি স্থান পেয়েছে রেকর্ড বইতে। ওয়ানডে ইতিহাসের পঞ্চম দীর্ঘতম ইনিংসটি ফারজানার, এক ম্যাচে তার চেয়ে বেশি বল খেলেছেন আর মাত্র ৪ জন ব্যাটার।
ফারজানার শতরানে দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, ৪ উইকেটে ২২৫ রান করেছে বাংলাদেশ। হ্যামিলটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭ উইকেটে ২৩৪ রান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ওয়ানডে ইনিংস।
ফারজানার এই ইনিংসে ভর করে গড়া বড় সংগ্রহেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সম্ভাবনা দেখেছিল ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের। যদিও শেষ পর্যন্ত সিরিজটা জেতা হয়নি বাংলাদেশের, তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচটা হয়েছে টাই। বাংলাদেশের ২২৫ রানের জবাবে ভারতও ৪৯.৩ ওভারে ২২৫ রানে অলআউট হয়ে যাওয়াতে মেয়েদের ওয়ানডে ক্রিকেটে নবমবারের মতো দেখা গেছে টাই।
তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ (Match) ১৮১ রান করে ফারজানা হয়েছেন সিরিজ সেরা। ম্যাচ(Match)এর পর সংবাদ সম্মেলনে এসে ফারজানা বলেন, ‘ আমি উপরে ব্যাটিং করতেই পছন্দ করি। আগের রাতে (শুক্রবার) আমাদের দলীয় বৈঠকের পর কোচ (হাশান তিলকরত্নে) আমাকে জানান যে আমাকে ইনিংসের সূচনায় যেতে হতে পারে। আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমার ইনিংসগুলো শুরু পেলেও লম্বা করতে পারছিলাম না। আগের ম্যাচেও (দ্বিতীয় ওয়ানডে) ৪৭ রানে আউট হয়েছিলাম, এরপর বন্ধুবান্ধব সবাই বলেছিল যে আর তিনটা রান হলে হাফসেঞ্চুরি হতো। তাই আজকে (শনিবার) চেয়েছিলাম যতটা সময় সম্ভব উইকেটে থাকবো।’’
ফারজানার জার্সি নম্বর ৯৯। সংবাদ সম্মেলন কক্ষ থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিবেদককে ফারজানা বললেন জার্সি নম্বরের রহস্য, ‘আমার জার্সি নম্বর ৯৯ ইচ্ছা করেই আমি বেছে নিয়েছি, যেন ১০০ করলে বলে যে ৯৯ এর ১০০।’’
সেই সঙ্গে জানালেন, বিকেএসপিতে নারী ক্রিকেটের প্রথম দিকের দিনগুলো, ‘ সে সময় মানজ্যোত সিং স্যার (বিকেএসপির সেসময়কার কোচ) আমাদেরকে খুব সহায়তা করেছেন। যে কোনো জিনিষেরই শুরুটা সবসময় ভালো হয় না। আমাদের ব্যাচটা যখন শুরু করে তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছে। মানজ্যোত স্যার সবসময় বলেছেন আমরা পারবো, আমরা যেন নিজেদের উপর ভরসা রাখি’।
সিরিজ সেরার পুরস্কার নিতে এসে ফারজানা জানান, তার উপর আস্থা ছিল সতীর্থদের, ”আসরের শুরু থেকেই বেশ ভালো ছন্দে ছিলাম। সতীর্থ সবাই বলছিল যে কেউ শতরান করলে আমিই করবো। আমার পরিকল্পনা ছিল যতটা বেশি সময় পারা যায় ব্যাট করা। আমি শতরান নিয়ে ভাবছিলাম না, চাইছিলাম দলের রানটা যেন ২৩০ এর মতো হয়। আমি ব্যাট করতেই পছন্দ করি। আমার জন্য দারুণ একটা সুযোগ এসেছিল আর আমি সেটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছি।”
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস বইতে অক্ষয় জায়গা পেয়ে গেলেন ফারজানা। নারী ক্রিকেটে ওয়ানডের প্রথম শতরান ফারজানার, এই ইতিহাস মুছে যাবে না কখনো। সেই সঙ্গে বোধহয় আমিনুল ইসলাম, মেহরাব হোসেনদের দুর্ভাগ্যেরও খানিকটা স্পর্শ পেলেন। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট এবং ওয়ানডে ম্যাচ এর দলকে জেতাতে পারেননি, দিনশেষে ফারজানাও তো পারলেন না জয়ী দলের অংশ হতে।
ম্যাচ(Match) এর সংক্ষিপ্ত স্কোরঃ
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২২৫/৪ (ফারজানা ১০৭, শামীমা ৫২; স্নেহ রানা ২/৪৫)।ভারত: ৪৯.৩ ওভারে ২২৫/১০ (হারলিন ৭৭, মন্ধানা ৫৯; নাহিদা ৩/৩৭, মারুফা ২/৫৫, রাবেয়া ১/৩০)। ফল: ম্যাচ টাই। সিরিজ: ১-১-এ সমতা। ম্যাচসেরা: হারলিন দেওল (ভারত)। সিরিজসেরা: ফারজানা হক পিংকি (বাংলাদেশ)।
সতীর্থদের ভবিষ্যদ্বাণীকে সঠিক প্রমাণ করতে পেরে খুশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে নজির গড়া ফারজানা হক পিংকি।