বিয়ের অন্যতম প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ অলংকার হচ্ছে নাকফুল। আর এই নাকফুলের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিবর্তন ঘটেছে মানুষের তৃতীয় ইন্দ্রিয়ের শোভা বর্ধনকারী অলঙ্কারের। এরপরে পরিবারের প্রভাব এবং প্রাচুর্য বোঝাতে নাকফুলের মধ্যে পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। হীরে, মুক্ত, পান্না, কুন্দন প্রভৃতি খোদাই করা শুরু হয় নাকফুলে। একই সঙ্গে শুরু হয় নানান ধরনের নকশার প্রচলন। এই ভাবেই শুরু হয় নাকফুলের বিবর্তন।
নাকফুল নিয়ে কত গান কবিতা, নাকফুল নিয়ে কত পুঁথির প্রিয় শ্লোক। নাকফুল চির রহস্যের অলংকার। নারীর নাকের সৌন্দর্য হল নাকফুল।
‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে,
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে’…
সেই ছেলেবেলায় কোন ক্লাসের যেন পাঠ্য ছিল কবি আল মাহমুদের অসাধারণ এই কবিতাটি।
নানাবিধ ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে নবম এবং দশম শতাব্দী থেকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে নাকফুল অলঙ্কার। মহিলাদের বৈবাহিক জীবনের চিহ্ন হিসেবে স্থান দেওয়া হয় এই নথ বা নাকফুলকে।।
ষোড়শ শতক থেকে সোনার অলঙ্কারের নকশা এবং আকারের ক্ষেত্রে ঘটে বিরাট বিপ্লব। শুরু হয় অলঙ্কারের বিবর্তন। যার ব্যতিক্রম হয়নি নাকফুলের ক্ষেত্রেও। নানান আকারের এবং নকশার ব্যবহার শুরু হয়। সমাজের উচ্চবিত্ত বা সমৃদ্ধশালী পরিবারের মহিলাদের নাকে উজ্জ্বল হয়ে থাকত সেই অলঙ্কার। সেই সময় থেকেই অতিমাত্রায় প্রচার পায় নাকফুল।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের দাবি নাকফুলের আবিষ্কার হয় প্রাচ্যের মাটিতে। মোঘলদের মাধ্যমে তা ভারতে পসার লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দিতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘলদের আগমনের পরই ওইসব অঞ্চলে মেয়েদের নাক ফোঁড়ানোর রেওয়াজ শুরু হয়।
সে সময় সেখানে নারীরা ঢাউস আকৃতির নাকফুল পড়তো, এখন সেখানে এর আকারে এসেছে পরিবর্তন, তবে এখনও কেউ কেউ জয়পুরি বড় নাকফুল পড়তে ভালবাসেন প্রাথমিক অবস্থায় কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলারাই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল।
পরে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতির একত্রীকরণ ঘটে এবং হিন্দু সমাজেও জায়গা করে নেয় নাকফুল। কালক্রমে হিন্দু বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে যায় নাকফুল।
ইসলামিক ইতিহাসের দিকে নাকফুল নিয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায় নাকফুলের চল মুসলিম নারীদের মধ্যে অনেক আগ থেকেই রয়েছে।
কথিত আছে, ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন বিবি সারা। বিবি সারার কোন সন্তান হতো না তাই তিনি নিজের ইচ্ছায় বিবি হাজেরার সাথে ইব্রাহীম (আঃ) এর বিয়ে দেন। ইব্রাহীম (আঃ) বিবি হাজেরার প্রতি অনেক ভালোবাসায় মগ্ন ছিলেন। তাই বিবি সারা রেগে গিয়ে হাজেরার নাক কান ফুটা করে দেন। ইব্রাহিম (আঃ) হাজেরাকে পছন্দ যেন না করেন তাই তিনি এ কাজ করেন। কিন্তু ইব্রাহিম (আঃ) যখন বিবি হাজেরার নাক কানে গহনা পরিয়ে দেন তখন তাকে আরও বেশি সুন্দর দেখায়!
আবার, অনেক অনেক আগে ফেরাওউনের স্ত্রী আসিয়া এর সময়ের কথা। ফেরাওউনের স্ত্রী আসিয়া দেখতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর ছিলেন তাই অন্যান্য স্ত্রীরা হিংসার বশবর্তী হয়ে তার নাক এবং কান ফুটা করে দেয় যাতে তাকে দেখতে অসুন্দর লাগে। কিন্তু এতে হয় হিতের বিপরীত। নাক এবং কান ফুটা করার পর তাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে। তখন থেকেই মেয়েরা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে নাক কাট ফুটা করছে।
আবার হিন্দু রীতিতে নাকফুলের ব্যবহারের প্রথার প্রমাণ মেলে তাদের প্রতিমা দেখলেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরাও সেই আদিকাল থেকেই নাকফুল ব্যবহার করে আসছে। তবে কিছু ইতিহাসবিদদের দাবি অনুসারে ভারতীয় সংস্কৃতির অনেক পুরনো অঙ্গ নাকফুল। তাদের পালটা যুক্তি পাঁচ হাজার বছর আগে হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তিতে নাকফুলের ব্যবহার করা হতো। যেগুলির অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। অনেক পুরনো গুহা এবং মন্দিরের মধ্যে অনেক খোদাই করা মূর্তিতেও নাকফুলসহ দেবীর মূর্তি দেখা গিয়েছে।
খৃষ্টানদের বাইবেলে লেখা আছে, ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলে ছেলের বউ রেবেকাকে স্নেহ এবং ভালবাসার চিহ্ন স্বরূপ নাকফুল উপহার দেন আব্রাহাম। এর কিছুদিন পর থেকেই বেদুইন এবং যাযাবরদের মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে নাকে গয়না পড়ার রীতি।
একসময় বাঙালি বিবাহিত নারীরাই কেবল নাকফুল পড়তেন। তখন স্বামীর মঙ্গল কামনায় বিয়ের পর নারীরা নাকফুল পড়তেন। আজকাল প্রায় সব বয়সী নারীরাই নাকফুল বা নথ পড়ছেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, যে নবম এবং দশম শতাব্দী থেকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে নাকফুল।
ষোড়শ শতাব্দিতে ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘলদের আগমনের পরই সোনার অলংকারের নকশা এবং আকারের ক্ষেত্রে ঘটে বিরাট বিপ্লব। শুরু হয় অলঙ্কারের বিবর্তন। যার ব্যতিক্রম হয়নি নাকফুলের ক্ষেত্রেও। নানান আকারের এবং নকশার ব্যবহার শুরু হয়। সমাজের উচ্চবিত্ত বা সমৃদ্ধশালী পরিবারের মহিলাদের নাকে উজ্জ্বল হয়ে থাকত সেই অলঙ্কার।