গ্রিসের ইজিয়ান সাগরের কোলে ছবির মতো সুন্দর চোখ ধাঁধানো এক দ্বীপ অবস্থিত। অসাধারণ এই দ্বীপের নাম হাইড্রা। এর আয়তন ২০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১,৯০০ মানুষ।
সেখানে প্রচুর পানির উৎস ছিল। একেবারে ভূমধ্যসাগরের জল দখিনের হাওয়ায় উড়ে এসে দ্বীপকে ভিজিয়ে দেয়। সেই থেকে দ্বীপের নাম হাইড্রা। প্রাচীনকালে এই দ্বীপটি হাইড্রিয়া নামে পরিচিত ছিল, যা দ্বীপের প্রাকৃতিক ঝর্ণার উল্লেখ ছিল। যদিও হাইড্রার অন্য একটা মানেও আছে। গ্রিক পুরাণে হাইড্রা হল বহু মুণ্ডবিশিষ্ট জলচর সরীসৃপ।
ছোট্ট এই দ্বীপের অনেক বিশেষত্ব রয়েছে। তার মাঝে চমকে দেয়া ব্যাপারটি হলো, হাইড্রায় আপনি কোনো বাইক, গাড়ি বা ট্যাক্সির খোঁজ পাবেন না! এখানে যন্ত্রচালিত সব ধরনের যানবাহন চলাচল একদম নিষিদ্ধ! কাজেই হাইড্রায় নেই কোনো কালো ধোঁয়া, নেই হর্নের বিরক্তিকর শব্দ। ঘোড়া অথবা গাধার পিঠে চড়ে অথবা ওয়াটার ট্যাক্সিতে করে ঘোরা যায় এই দ্বীপে।
তুর্কিদের অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসা, হাইড্রায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা নৌ চালনায় ও নৌ নির্মাণে পটু ছিল। নৌবিদ্যায় হাইড্রার মানুষের নাম খুব ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে পুরো গ্রিক যখন একত্র হয়ে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামল তখন মোট যুদ্ধজাহাজের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল হাইড্রার নৌবাহিনীর।
হাইড্রার উত্তরাংশে জাহাজঘাটের কাছাকাছি রয়েছে সব হোটেল এবং ভোজনশালা। হাইড্রাতে মেলে গ্রিক খাবার। তাজা গ্রিলড মাছ হাইড্রার বিশেষত্ব। চিকেনের তেমন চল নেই এখানে। রসুন ও ক্রিমসহযোগে সুভলাকি নামে একটা খাবার তৈরি হয়- যা অনেকেরই পছন্দ। গ্রিসের জাতীয় পানীয় হল- ‘উজো’। উজো মদিরাটি মৌরি থেকে উৎপন্ন। মৌরির লোভনীয় ঘ্রাণ পর্যটকদের বেশ আনন্দ দেয়। হাইড্রাতে প্রচুর পেস্তা মেলে। খোসাসুদ্ধ সল্টেড পেস্তা, ছোট-বড় অনেক দোকানে প্লাস্টিক প্যাকেটে সাজানো থাকে এই পেস্তা।
হাইড্রাতে গয়নার দোকান বেশি। শুধু তাই নয়, মনোহারি দোকানেও গয়না মেলে। এখানে সব দোকানেই অ্যামব্রয়ডারি করা জামা, ঘাগরা বিক্রি হয় যা খুবই সুন্দর এবং মূল্যবান।
আরো পড়ুন …
হাইড্রায় পুরনো কিছু বড় প্রাসাদোপম বাড়ি আছে। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পাওয়া জনপ্রিয় ক্লাসিক সিনেমায় ‘ক্লিওপেট্রা’ এর নাম ভূমিকায় অভিনয় করা বিখ্যাত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেইলর বাড়ি কিনেছিলেন এই ছোট্ট দ্বীপ হাইড্রায়। এছাড়া অনেক শিল্পী, লেখকের বাড়ি আছে এখানে। তারা হাইড্রার শান্ত নিরুদ্বেগ আবহে নিশ্চিন্তে কয়েকদিন কাটিয়ে যান। আর দ্বীপটা ফিল্ম ডিরেক্টরদেরও খুব পছন্দ।
গ্রিসের হাইড্রা দ্বীপের প্রধান দ্রষ্টব্য- মাউন্ট এরোস, ৫০০ মিটার উঁচু পাহাড়, অসংখ্য পুরনো অট্টালিকা। এর অধিকাংশই পাথরে তৈরি। গ্রিসের প্রথম প্রেসিডেন্টের অট্টালিকাও রয়েছে এখানে। হাইড্রা থেকে গাধায় আসীন হয়ে এরোসে যাওয়া যায়।
হাইড্রার যাদুঘরগুলি দর্শনার্থীদের জন্য ঘুরে দেখার মত যা এর ইতিহাসের সাথে যুক্ত রয়েছে। হাইড্রায় রোমান্টিক এবং কাব্যিক এক আভা বিরাজ করে এবং দর্শনার্থীরা এমন পরিবেশ খুব উপভোগ করে থাকে। স্থানীয়দের থেকে বেশ অতিথি সুলভ আচরন পেয়ে থাকে পর্যটকেরা এবং বিদেশী পর্যটকদের মতো বোধ করে থাকে। সব মিলিয়ে গ্রিসের এই অপূর্ব দ্বীপটি হতে পারে আপনার ভ্রমনের এর জন্য অন্যতম গন্তব্য।
হাইড্রা গ্রীষ্মের মাসগুলিতে শিল্প উত্সাহীদের জন্য বিশেষ আগ্রহ অর্জন করে। বছরের পর বছর ধরে, দ্বীপটি শিল্পীদের জন্য একটি প্রধান চিত্র আঁকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি দ্বীপটিকে সমসাময়িক শৈল্পিক পরিচয় প্রদান করে বিভিন্ন শৈল্পিক ক্ষেত্রের শিল্পীদের আকর্ষণ করে চলেছে।
দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অটুট রাখতে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ এই দ্বীপে। তবে আপনি পাবেন ঘোড়া এবং গাধা! জ্বি, ঠিকই দেখছেন। এখানে চলাচলের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে ঘোড়া এবং গাধা! ছোট্ট একটি দ্বীপ, ধুলো উড়িয়ে যায় গাধা টানা গাড়ি। গাধায় চড়েই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হবে আপনাকে। নইলে “নিজের পা”ই আপনার একমাত্র সম্বল। তবে পায়ে হেঁটে এমন অপূর্ব একটি জায়গা ঘুরে দেখতে আপনার একটুও অস্বস্তি লাগবে না, সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পুরো দ্বীপটাই ইজিয়ান নামের সুন্দর এক ছোট্ট সাগর দিয়ে ঘেরা, কাজেই ওয়াটার ট্যাক্সি পাবেন প্রচুর। এই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে প্রিয় মানুষটির হাতে হাত রেখে পুরো হাইড্রা দ্বীপটা ঘুরে দেখা হতে পারে, আপনার জীবনের অন্যতম সেরা স্মৃতিগুলোর একটি!
বুনো প্রকৃতি আর আধুনিকতার মিশেলে গড়ে উঠেছে গ্রীসের এই অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ হাইড্রা। হানিমুন গন্তব্য হিসেবে হাইড্রার নামটা টুকে রাখতে পারেন এখনি!
লিখেছেন – সৈয়দা ফাতেমা আমীন