কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ঊনবিংশ, বিংশ এমন কী একবিংশ শতাব্দীর নিরিখে ও একজন আশ্চর্য মানুষ, যাঁকে কোন মানদন্ডেই সম্পূর্ণ মাপা যায় না। যেযুগে নারীরা ছিল সমাজে চরমভাবে অবহেলিত, তাদের প্রাথমিক শিক্ষালাভের পথও যেখানে ছিল দিবাস্বপ্ন, সেখানে সেই একই যুগের একই সমাজে থেকে, জীবনে কিভাবে তিনি সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠলেন, অবলীলায় সামাজিক বিপত্তির বেড়ি ভেঙে অগ্রসর হলেন যথেষ্ট কষ্ট ও প্রতিকূলতাকে জয় করে – এ প্রশ্ন যে কাউকে আজও ভাবায়|
ডাঃ কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায় জাতীয়তা ব্রিটিশ ভারতীয়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ‘কাদম্বিনী দেবী’ নামে সমধিক পরিচিত। একবার ফিরে দেখা যাক অনমনীয় এই মহিলার সেই মহৎ কীর্তি।
ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক ব্রজকিশোর বসু ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদসীতে ছিল তাঁদের পৈতৃক ভিটে। চাকুরিসুত্রে ব্রজকিশোর বসুকে থাকতে হয় বিহারের ভাগলপুরে।
১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই বিহারের ভাগলপুরে (মতান্তরে পরিবারের আদি বাসস্থান বরিশালের চাঁদসীতে) জন্ম হয় কাদম্বিনী বসুর। তাঁর বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ব্রাহ্ম এবং নারীশিক্ষায় অত্যন্ত উৎসাহী। তিনি অভয়চরণ মল্লিকের সঙ্গে ভাগলপুরে মহিলাদের অধিকারের আন্দোলন করেছিলেন। ১৮৬৩ সালে সেখানে তিনি নারীমুক্তির জন্য প্রথম ভারতীয় মহিলা সংগঠন ‘ভাগলপুর মহিলা সমিতি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।
ব্রাহ্ম সমাজের অনুপ্রেরণাতেই কাদম্বনীর বাবা ব্রজকিশোর বসু মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে উদ্যোগী হন। কাদম্বিনীর শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার ইডেন মহিলা বিদ্যালয়ে। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মেয়েকে ভাগলপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। বাবার অনেক সাহায্য ও উৎসাহ পাওয়া সত্ত্বেও কাদম্বিনীর পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহন সহজ ছিল না কারন তৎকালীন সমাজ নারীশিক্ষাকে মোটেই সুনজরে দেখেনি। কিন্তু তেজি কাদম্বিনী সেই চোখরাঙানিকে অবজ্ঞা করে ১৮৭৩ সালে ভর্তি হন কলকাতায় বালিগঞ্জের হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে। সেই বছরই স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল (পরবর্তী কালে স্কুলটির নাম হয় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়)। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় প্রবল উৎসাহী ব্রাহ্ম সমাজনেতা ও অবলাবান্ধব নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক পণ্ডিত দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী।
১৮৭৭ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাস যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর বেথুন স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি ১৮৭৮ সালে প্রথম নারী হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। তার দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে বেথুন কলেজ প্রথম এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) এবং তারপর অন্যান্য স্নাতক শ্রেণি আরম্ভ করে।
কলকাতা মির্জাপুরের রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জীর দানকৃত জমিতে শুধুমাত্র কাদম্বিনী বসুকে ছাত্রী তালিকাভুক্ত করে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাস মহিলাদের মধ্যে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পান। কী কারণে যেন সরলা দাস পরীক্ষা দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত শুধু কাদম্বিনী বসু পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন (১৮৭৮ খ্রি.)।
মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ না পেলেও সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করেছিলেন। বাংলার প্রথম দু’জন মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্র মূখী বসু (১৮৬৯-১৯৪৫ খ্রি.)। এঁরা দু’জনেই ১৮৭৯তে এফএ পাশ করলেন এবং তাঁদের যুগ্ম সাফল্য বেথুন কলেজে বিএ পড়ানোর দরজা খুলে গিয়েছিলো।
১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে ইতিহাস গড়ে দু’জনে বিএ পাশ করলেন। দেশের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েট। সে বার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দুই মহিলার ডিগ্রি নেওয়া দেখতে এত ভিড় হয়েছিল যে, পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। ভিড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে ট্রামলাইন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। লর্ড লিটন নিজে তাঁর প্রশংসা করেন। লেডি লিটনের হাত দিয়ে তাঁকে পুরস্কার ও সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
কাদম্বিনীর চিকিৎসাশাস্রে পড়ার সিদ্ধান্ত
বাংলা তখনও ব্রিটিশদের পদানত। সেই সময় বাড়ির মেয়েরা প্রায়ই সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারা যেতেন, শুধুমাত্র পুরুষ ডাক্তার তাদের দেখবেন না বলে এবং সেই সময়ের বেশির ভাগে ডাক্তার ছিলেন সাহেব। জাত-ধর্ম যাওয়ার ভয়ে পর্দানসীন মেয়েদের ধারেপাশে ঘেঁষতে দেওয়া হত না তাঁদের। এই দৃশ্য ছোটবেলায় মনে দাগ কেটেছিল কাদম্বিনীর। তার বাড়ির অসুস্থ আত্মীয়াকে না দেখিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল সাহেব ডাক্তারবাবুকে। তারপরেই প্রতিজ্ঞা করে সে, বড় হয়ে ডাক্তার হবে।
স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কাদম্বিনী দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার। নারী শিক্ষার সমর্থক পিতা ব্রজকিশোর বসু সানন্দে কন্যার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। কলকাতার অভিজাত সমাজ নানাভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ করতে শুরু করে। তিনি যাতে ডাক্তারি পড়তে না পারেন, চলল তার জন্য নানা অপচেষ্টাও। ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না কাদম্বিনীও।
বিয়ে
১৮৮৩ সালের দেশের প্রথম মহিলা স্নাতক কাদম্বিনীর শিক্ষা ও সৌন্দর্যের খ্যাতি সারাদেশে সেসময় বহুল চর্চিত। এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর যশগাথা, প্রতিনিয়ত দেশী-বিদেশী নানা জনের কাছ থেকে আসছে বিয়ের প্রস্তাব। তিনি ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দরী, আধুনিকা একজন মহিলা। শোনা যায় তাঁর রূপ গুণে মুগ্ধ হয়ে সিংহলের এক ব্যারন দিয়েছিলেন বিয়ের প্রস্তাব।
১৮৮৩ সালের ১২ জুন, কাদম্বিনী ডাক্তারি পড়তে শুরু করার সময়েই বিপত্নীক দ্বারকানাথের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ২০ এপ্রিল ১৮৪৪ সালে বিক্রমপুরের মাগুরখণ্ড গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গোপাধ্যায়। ১৮ বছরের ছোট কাদম্বিনী ছিলেন, ৩৯ বছর বয়স্ক বিপত্নীক দ্বারকানাথের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। দ্বারকানাথ কাদম্বিনীর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তার উপরে তিনি বিপত্নীক ও দুই সন্তানের পিতা।
মেয়ে বিধুমুখী প্রায় কাদম্বিনীর বয়সি। ছেলে সতীশচন্দ্র রিকেটরোগী ও মানসিক প্রতিবন্ধী। শোনা যায়, এই ছেলের চিকিৎসার যাবতীয় ভার নিয়েছিলেন বিমাতা কাদম্বিনী। সুস্থ করতে নিজের হাতে সোনা ব্যাঙের ঝোল রেঁধে সতীশকে খাওয়াতেন।
দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ছিলেন ব্রাহ্মণ, কাদম্বিনী কায়স্থ। এতে হিন্দু সমাজ ক্ষুব্ধ হয়। দ্বারকানাথের এই বিয়ে তাঁর অনেক আত্মীয় এমনকি আধুনিকমনস্ক ব্রাহ্ম নেতারাও মেনে নিতে পারেননি। রাগ করে এই বিয়েতে সেকারণে দ্বারকানাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী পর্যন্ত আসেননি।
সেই সময় বিয়ের পরে মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারতেন না। কিন্তু কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে একেবারেই তা হয়নি। দ্বারকানাথের আগ্রহেই কাদম্বিনী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। কাদম্বিনীর সংগ্রাম ও প্রতিষ্ঠালাভের জন্য তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা, দৃঢ়তা, পরিশ্রম, মেধা ও ক্ষমতার সঙ্গে স্বামীর অকুন্ঠ সহযোগিতারও অত্যন্ত মূল্যবান ভূমিকা ছিল। তাঁদের পনেরো বছরের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত সফল সম মনোভাব ও পারস্পরিক সাহচর্যের ভিত্তিতে কেটেছিল।
চিকিৎসা শাস্রে পড়ার সংগ্রাম জয়
১৮৮২ সাল পর্যন্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল কোন নারীকে শিক্ষালাভের অনুমতি দেন নি। তখন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সংগ্রাম শুরু হয় এবং ১৮৮৩ সালে তিনি অসাধ্যসাধন করেন। মেডিকেল কাউন্সিলের কাছে হতাশ হয়ে ডিপি আই সরকারের কাছে জানতে চান, ‘ডাক্তারি পড়তে ইচ্ছুক ও যোগ্য মহিলাদের কি জবাব দেওয়া হবে?’ ডিপিআই ১৮৮৩ সালে ৪ জুন মেডিক্যাল কাউন্সিলে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চান, কী উত্তর দেবেন?
১৮৮৩ সালের ২৯শে জুন (মতান্তরে ২৩ জুন) সরকারীভাবে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বাতিল করে কাদম্বিনীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হল। মেডিকেল কলেজের নিয়ম ছিল, বি এ পাশ করলেই বিনা খরচে মেডিসিন পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। কাদম্বিনী এই সুযোগ নিয়ে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করলেন প্রথম ছাত্রী হিসাবে, যুগযুগান্তের এক রুদ্ধদ্বার খুলে দিলেন নারীদের জন্য। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন তিনি সে যুগে মাসে ২০ টাকা সরকারি স্কলারশিপ পেতেন।
সামাজিক বাধাবিপত্তি
কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে একাগ্রচিত্তে পড়াশোনা শুরু করেন। তবে কাদম্বিনীর মেডিকেল কলেজে প্রবেশ করার এই ঘটনা সমাজের অনেকের কাছেই অসহ্য মনে হয়, নানা তিক্ত মন্তব্য ও বিরোধিতা চলতেই থাকে।
১৮৮৩ সালের ২রা জুলাই আনন্দবাজার (অমৃতবাজার বলেছেন কেউ) পত্রিকায় মেডিকেল কলেজে পুরুষ ছাত্রদের সঙ্গে মহিলা ছাত্রীদের একত্র অধ্যয়নে কি কি অসুবিধা তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়। আরও অন্যান্য আপত্তির মধ্যে উক্ত কলেজের একদল ছাত্র বলেন যে, “নিয়ম আছে সমস্ত বক্তৃ্তাতে উপস্থিত না থাকিলে পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। এবং যদি এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে যদি কোন রমণীর গর্ভ হয়, তবে প্রসবকালীন তিনি কি করিয়া বক্তৃ্তায় উপস্থিত থাকিবেন? আপত্তি কয়েকটি যুক্তিসঙ্গত।”
বিদেশেও তখন মেয়েদের ডাক্তারি পড়া আটকাতে কিছু অধ্যাপক ক্লাসে নির্লজ্জ ভাবে মানবদেহের ডেমনস্ট্রেশন দিতেন। বম্বের গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজেও ছাত্রীরা ছাত্রদের কাছ থেকে কটূক্তি ও অশালীন আচরণ পেয়েছিলেন। তবে কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় কোন অশালীন ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছিলেন বলে জানা যায় নি, তিনি ছিলেন অত্যন্ত গম্ভীর ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী।
তখন শুধু রক্ষণশীল সমাজই নয়, তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে মেডিক্যাল কলেজের টিচিং স্টাফও। মেডিক্যালের চিকিৎসকদের একাংশ তা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলেন না। তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র। তিনি বিলেতে লর্ড পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু স্ত্রী শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অতি রক্ষণশীল এই চিকিৎসক কাদম্বিনীর মেডিক্যাল পড়ার খোলাখুলি প্রতিবাদ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিন বছরের শেষে প্রথম পরীক্ষায় তাঁর মেডিসিন পেপারে এক নম্বরের জন্য কাদম্বিনীকে ফেল করিয়েছিলেন। ১৮৮৮ সালের ফাইনাল পরীক্ষায় তাকে ফেল করিয়ে দিলেন এই বাঙালি অধ্যাপক, তাও মাত্র ১ নম্বরের জন্য!
আরো পড়ুন
- ওয়ানডে ম্যাচের ইতিহাসে বাংলাদেশের সেঞ্চুরিয়ান প্রথম নারী ফারজানা
- দেশের প্রথম নারী প্যারা কমান্ডো জান্নাতুল ফেরদৌস
- কেন এখন বিয়ের উপহার (Marriage Gift) উপহার হিসেবে নগদ টাকাই বেশি প্রত্যাশিত !!
- স্বাস্থ্যকর নখ (Nails) বজায় রাখার টিপস
- লিপস্টিক এর আবিষ্কার
অন্যদিকে, গোঁড়া হিন্দুরা তাঁর ডাক্তার হওয়াটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখে নি, সমাজছাড়া জীব হিসেবে তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা-মস্করা শুরু হয়। একজন মেয়ে সবার মুখে ঝামা ঘষে এত সহজে ডাক্তার হয়ে যাবেন তাই এবার বিরোধিতা শুরু হল প্রকাশ্যে। তাকে নিয়ে শুরু হল বিদ্রুপ। তিনি একই সঙ্গে চিকিৎসক ও সফল স্ত্রী এবং দায়িত্বশীল মাতার ভূমিকা অত্যান্ত সফলভাবে পালন করলেও সনাতনপন্থী সাময়িকী “বঙ্গবাসী” তাঁকে পরোক্ষভাবে আঘাত করে।
১৮৯১ সালে ‘বঙ্গবাসী’ সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল তাঁর মাথা নত করে দেওয়ার জন্য একটি কার্টুন ছাপলেন, যাতে দেখানো হয়েছিল বারবনিতা ডাঃ কাদম্বিনী তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাকে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নীচে লেখা ছিল কুরুচিকর নানা মন্তব্য। কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন পত্রিকা সম্পাদক। কারণ কাদম্বিনী নাকি মোটেই ঘরোয়া ‘বাঙালি বউ’ নন।
কাদম্বিনী চুপ থাকার পাত্রী নন। বঙ্গবাসী কাগজের সম্পাদক মহেন্দ্রলাল পালের এহেন অসভ্যতাকে মোটেই প্রশ্রয় দেননি কাদম্বিনীদেবী বা তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। দ্বারকানাথ অবিলম্বে পত্রিকা অফিসে হাজির হয়ে সম্পাদককে কার্টুনটি জল দিয়ে গিলে খেতে বাধ্য করেন ও আদালতে অভিযোগ জানিয়ে মামলা করেন তাঁরা। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের ১০০ টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হল। সেই সময় এই ধরনের মামলা করা, বিশেষ করে একশক্তিশালী পুরুষ কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো নারীর মানহানির মামলা করাটা মোটেই কিন্তু সহজ কাজ ছিল না।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক
কাদম্বিনী মেডিকেলের তিন বছরের মাথার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এই অকৃতকার্য হবার পেছনে ছিল কিছু মানুষের দীর্ঘ দিনের লালিত অসূয়া। এদের পুরোভাগে ডক্টর রাজেন্দ্র চন্দ্র যিনি মেডিকেল কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কাদম্বিনীর মেডিকেল কলেজে অ্যাডমিশানের তুমুল বিরোধিতা করেছিলেন। ডক্টর চন্দ্র এর পেপারেই এক নম্বরে ফেল করেন কাদম্বিনী। কাদম্বিনীর প্রতি ডা. চন্দ্রের অসূয়ার কারণ ব্যক্তিগত ছিল কি না জানার যায়না। শ্রদ্ধেয় নারায়ণ দত্ত (“কাদম্বিনী ও তাঁর বিলিতি ডিপ্লোমা, দেশ: ১৪ মার্চ, ১৯৮৭) অবশ্য একটা প্রশ্ন উত্থাপিত করেছেন, “…কাদম্বিনীর অপরূপ সৌন্দর্যই কি পাশ করার মতো নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে উঠেছিল?” জানা যায় যে, বিবাহ পরবর্তীকালে তিনি নাকি মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় অন্তঃস্বত্তা কালীন ছুটি হিসেবে মাত্র ১৩ দিন অনুপস্থিত ছিলেন।
মেডিক্যাল কলেজে তাঁর পড়া নিয়েও এতটাই আপত্তি ছিল সাধারন বাঙ্গালী পণ্ডিত সমাজ থেকে, যে শেষপর্যন্ত তারা এমনও শর্ত দেয় যে কাদম্বিনী কোনও পুরুষ শরীর ব্যবচ্ছেদ করতে পারবেনা। ফাইন্যাল পরীক্ষায় তিনি ডক্টর চন্দ্রর পেপারেই অকৃতকার্য হন। তখন অধ্যক্ষ ডঃ কোটস এর উদ্যোগে, পেলেন জি এম সি বি অর্থাৎ “গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল” ডিগ্রী এবং প্র্যাক্টিস করার ছাড়পত্র।
কাদম্বিনী ডাক্তারি পাশ করেন ১৮৮৬ সালে। তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার, যিনি ওয়েস্টার্ন মেডিসিন নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতা অর্জন করেন। ১৮৮৭ সালের কনভোকেশনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর উচ্চ প্রশংসা করেন। তাঁর প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক বাঙালি মেয়ে মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করেছেন।
মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করে ১৮৮৮ সালে তিনি কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন; তখনকার হিসেবে যা ছিল বেশ উচ্চ বেতন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ডাক্তারির ভবিষ্যত। আর এর কিছু পরেই তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে শুরু করেন। তৈরী হল এক নতুন ইতিহাস, অনেক লড়াই করে ভারতের প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, তখন স্বীকৃত হলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক (প্র্যাকটিশনার) হিসেবে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে ডাফরিন হাসপাতালে কাজ পেতে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অনেক সাহায্য করেছিলেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের তাঁর এক ভারতীয় বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, সুদূর বিদেশে বসে যেখানে উনি কাদম্বিনী সম্পর্কে বিশদে জানতে চেয়েছেন।
“Do you know or could tell me anything about Mrs Ganguly, or give me any advice? … (she) has already passed what is called the first licentiate in medicine and surgery examinations and is to go up for the final examination in March next. This young lady, Mrs. Ganguly, married! after she made up her mind to become a doctor! and has had one, if not two children since. But she was absent only thirteen days for her lying-in!! and did not miss, I believe, a single lecture!!”
“কে এই মিসেস গাঙ্গুলী, আমায় কিছু জানাতে পারো? সে নাকি এর মধ্যেই ফার্স্ট লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি পাশ করে ফেলেছে আর আগামী মার্চ মাসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। এই তরুণী বিয়ে করে ফেলেছে, ডাক্তার হবে ঠিক করার পরে! তার পর অন্তত একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, যদি না দুটি জন্মে থাকে। কিন্তু ছুটি নিয়েছিল মাত্র ১৩ দিন, আর শুনছি নাকি একটাও লেকচার মিস করেনি!” (২০ ফেব্রুয়ারী, ১৮৮৮)
কাদম্বিনী গাঙ্গুলী বিশ্বের জ্ঞানীগুণী মহলে কী বিশাল বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন,এই চিঠিটিতে তার নিদর্শন রয়েছে। তাঁর এই চিঠিটি এক অমূল্য দলিল।
কাদম্বিনীর বিলিতি ডিগ্রি অর্জন
দ্বারকানাথের উৎসাহে এক বছর বয়সের কনিষ্ঠ পুত্রসহ পাঁচটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে স্বামী এবং সৎ কন্যা বিধুমুখীর তত্ত্বাবধানে কলকাতায় রেখে বিলেতে যান কাদম্বিনী। বিলেত যাওয়ার অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন শিকাগো মহাসম্মেলনের প্রদর্শনীতে ভারতীয় মহিলাদের শিল্পকর্ম পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিয়ে।
১৮৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ১৮৯২ সালে) মিস প্যাশ নামে মহিলার সঙ্গিনী হয়ে জাহাজে একা বিদেশযাত্রা করেন। লন্ডন পৌঁছন ২৩ মার্চ। লন্ডন পৌঁছনোর কুড়ি দিনের মধ্যে কাদম্বিনী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদনপত্র জমা দেন ও তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা 35, Blackfield road, Mydavelle, London থেকে ক্লাশ করা শুরু করেন। তিনি পরতেন শাড়ি, ফুলহাতা ব্লাউজ; স্কার্টব্লাউজ নয়। সেই সময় বিলেতের বুকে বিলিতি পোশাককে অগ্রাহ্য করে ভারতীয় পোশাকে ক্লাস করাটা কত কঠিন ছিল, সেটা আজ হয়তো বোঝা সম্ভব নয়।
ক্লাস করতেন এডিনবরায়। তার পরে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একটি নয়, তিন তিনটা ডিগ্রি যথাক্রমে এল আর সিসি (এডিনবরা), এলআরসিএস (গ্লাসগো) ও জিএফসিএস (ডাবলিন) নিয়ে স্বদেশে ফিরলেন। এবার তিনি হলেন বিলিতি ডিগ্রিধারী প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার যিনি ভারতে ফিরে এসে ডাক্তারি শুরু করেন।
শোনা যায়, কাদম্বিনী ফিরে এসে ছোট ছেলে জংলুকে (প্রভাতচন্দ্র) কোলে নিতে গেলে বছর দেড়েকের ছেলে দীর্ঘ দিন না দেখায় নিজের মাকে চিনতে পারেনি! দিদিমার গলা আঁকড়ে ছিল। কাদম্বিনী আড়ালে কেঁদেছিলেন। কিন্তু কখনওই সংসার তাঁর কেরিয়ারের অন্তরায় হয়নি।
চিকিৎসক কাদম্বিনী তাঁর যোগ্যতার পদ বা চাকরি পাননি। কিছু দিন ডাফরিন হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তারের চাকরি করে ইস্তফা দিয়ে নিজের বাড়িতে চেম্বার খুলে পুরোপুরি প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। পসার জমে ওঠে দ্রুত। দ্বারকানাথের উৎসাহে, তার চেম্বার খুললেন বেনিয়াটোলা লেন ও সুকিয়া স্ট্রিটে। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকাতে যার বিজ্ঞাপনে লেখা হল –
MRS. KADAMBINI GANGULY B.A.
G.M.C.B.Medical Practitioner.
Can be consulted at her residence, 45-5 Beniatola Lane, College Square, Calcutta,
Terms Moderate.
কাদম্বিনী পাঁচ শিশু সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতেন। যা সেসময় ভাবতেই পারতেন না কেউ। একে নারী চিকিৎসক তার উপর অন্যের বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা! এক অসম্ভব বিষয় ছিল। কাদম্বিনী বিশেষ করে সেই সব নারীদের বাড়ি যেতেন যারা অসুস্থ হলেও হাসপাতালে আসার সুযোগ পেতেন না। তখন দেশীয় মহিলা ডাক্তারের অসম্ভব প্রয়োজন ছিল, তাই ভারতে ফেরার পর কাদম্বিনীকে আর পিছন ফিরে তাকায় নি। যে শহরে প্রথমদিকে তিনি ডাক্তার হিসেবে গুরুত্ব পান নি, সেখানেই প্রবল প্রতাপে রোগী দেখে বেড়িয়েছেন ফিটনগাড়ি চেপে, যে রোগিণীর পেটে টিউমার আছে বলে বড় বড় ডাক্তাররা নিদান দিয়েছেন, তাকে দেখে তিনি নিশ্চিতভাবে বলেছেন বধূটি অন্তঃসত্ত্বা, নির্বিঘ্নে তার প্রসব করিয়েছেন। চিকিৎসা করার জন্য ছুটে যেতেন গ্রামান্তরে।
সমাজসংস্কার ও রাজনীতিতে কাদম্বিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসমূহ
ডা. কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর কর্মকান্ড যে শুধুই চিকিৎসাশাস্ত্রে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সমাজসংস্কার ও রাজনীতিতেও তার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি ভারত-সভা এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেসে তিনিই প্রথম নারীদের প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলেন। যার ফলে কাদম্বিনীর নেতৃত্বে ১৮৮৯ সালে প্রথম ৬ জন নারী বোম্বে বর্তমানে মুম্বাই শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী ও তাঁর মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন।
দ্বারকানাথের স্ত্রী কাদম্বিনী-ই কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম নারী বক্তা ছিলেন। মাতৃভাষার মতো স্বচ্ছন্দে ও নিখুঁত উচ্চারণে প্রদত্ত তার বক্তব্য সকলের মনে দাগ কেটেছিল। আর রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী ও কাদম্বিনী বসু জাতীয় কংগ্রেসের সর্বপ্রথম দুই নারী সদস্যা ছিলেন। তাঁরাই আবার কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম নারী সদস্যা হিসেবে যোগদান করেন। পরের বছর কাদম্বিনী বসু কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক।
তিনি গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি এবং ১৯০৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্স ভালের সত্যাগ্রহী শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কোলকাতায় এক সভার আয়োজন ও তাতে সভাপতিত্ব করেন।
১৯১৪ সালে তিনি কলকাতায় ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ এর অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ অধিবেশন মহাত্মা গান্ধী কোলকাতায় এলে তাঁর সম্মানের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল।
বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ লিখেছেন,
“গাঙ্গুলির স্ত্রী কাদম্বিনী ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে স্ফয় এবং স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। সব বাধার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে নিজেকে জানার তার এই ক্ষমতা তাকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করে। ”
সেই সময় আসামের চা-বাগানগুলিতে বাগিচা-শ্রমিকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতো ইংরেজ বাগান-মালিকরা। দ্বারকানাথ আসামের চা- বাগানের শ্রমিকদের অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাঁর উৎসাহে কাদম্বিনী নিজে গিয়েও তা দেখেন। তিনি আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন। চা বাগানের নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন। ইউরোপীয় মালিকদের অত্যাচারের খবর দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা সঞ্জীবনীতে প্রকাশিত হয় এবং এর ফলে গণসচেতনতার মাধ্যমে এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
কবি কামিনী রায়ের সাথে কাদম্বিনী দেবী ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিহার এবং ওড়িষ্যার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্নস্থানের খনিতে কর্মরত নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের হুমকির ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে এই বিষয়ে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্যে পরামর্শ দেন এই দম্পতি।
তাঁর জীবন তিনি মারাত্মক লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণবাদ, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বঞ্চিত শ্রেণির সংগ্রাম এবং সেই সময়ের আরও অনেক কিছুর সাক্ষী। সত্যাগ্রহ আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ-বয়কট আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর পরিবার
কাদম্বিনী মাতৃস্নেহে পালন করেছেন দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের দুই সন্তান বিধুমুখী ও সতীশচন্দ্রকে। দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর সন্তানরা হলেন – নির্মল চন্দ্র (ভুলু), মনোরমা (বেলা), প্রফুল্লচন্দ্র (মঙলু), জ্যোতির্ময়ী (চামেলী), প্রভাতচন্দ্র (জঙ্লু), অমলচন্দ্র (খোকন), জয়ন্তী, হিমানী (ছোট্ট বেলায় মারা যান)।
প্রভাতচন্দ্রের বড় ছেলে, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের দুই পুত্র পার্থ ও রাজীব। আজও দ্বারকানাথ-কাদাম্বিনীর উত্তরসুরী হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের শ্রীযুক্ত রাজীব গাঙ্গুলী (প্রপৌত্র) ও তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী দীপান্বিতা (প্রপৌত্রবধূ) যথেষ্ট ভাবে সচেষ্ট তাঁদের কথা সবার কাছে তুলে ধরায়।
কাদম্বিনী দেবীর সৎ কন্যা বিধুমুখীর সাথে উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বিবাহ হয়েছিল। সুতরাং সেই সম্পর্কে কাদম্বিনী ছিলেন, সুকুমার রায়ের দিদিমা। ব্রাহ্ম হিসেবে ঠাকুরবাড়ির সাথে একটা পারিবারিক যোগাযোগ পূর্ব থেকেই ছিল। শোনা যায়, দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর ছয় নম্বর গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়িটির ছাদে রবীন্দ্রনাথ মাঘোৎসবের গান শেখাতে আসতেন, গান গলায় তুলে নিতে আসতেন যে যুবকরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন নরেন্দ্র দত্ত, বেহালা হাতে বসতেন উপেন্দ্রকিশোর।
কাদম্বিনী দেবীর জীবনধারা
কাদম্বিনীর নাতনী পুণ্যলতা চক্রবর্তীর লেখা থেকে মানুষ কাদম্বিনী সম্পর্কে জানা যায় – “একদিকে খুব সাহসী আর তেজস্বিনী অন্যদিকে ভারী আমুদে মানুষ…মাতৃভাষার মত অনর্গল ইংরেজি বলতে পারতেন। তিনি বেশ সুন্দরী ছিলেন। তখনকার সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশনের শাড়ি, জামা, জুতো পরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতেন… একটুও সময় তিনি নষ্ট করতেন না। যখন যেখানে বসতেন হাসি গল্পে একেবারে মাতিয়ে তুলতেন।” পুণ্যলতা আরও জানিয়েছেন, বাড়িতে একটা ঘরে ছোটরা ঢুকত না। ওটা ছিল কাদম্বিনীর পড়াশোনার ঘর। ছোটরা বলত ‘কঙ্কালের ঘর’। তার দেওয়ালে মানুষের আস্ত কঙ্কাল ঝুলত। আলমারিতে মোটা মোটা বই, তাকের উপরে সারি সারি শিশিবোতল আর কী সব যন্ত্রপাতি।
বিশিষ্ট লেখিকা লীলা মজুমদার ছিলেন কাদম্বিনীর আত্মীয়া। কাদম্বিনীর সৎ মেয়ে বিধুমুখী হলেন লীলা মজুমদারের জেঠিমা। লীলা মজুমদার “উপেন্দ্রকিশোর” বইতে লিখেছেন, ”সাজসজ্জাতেও কাদম্বিনী ছিলেন তখনকার আধুনিকা। তখনকার মহিলারা কৃত্রিম কিছু ব্যবহার করতেন না কিন্তু ভারতের ভিক্টোরীয় যুগের এই আধুনিকা মহিলার চালচলন সাজসজ্জাতে ভারি একটা সম্ভ্রান্ত রুচির সঙ্গে গাম্ভীর্যের মিশ্রন ছিল। অনেকটা পারসি মেয়েদের মত করে কাপড় পরে বাঁ কাঁধে সোনার সেফটিপিন লাগাতেন। মাথায় তিনকোনা ভেল পরতেন, দুটি খুদে খুদে ব্রুচ দিয়ে আটকে, কনুই পর্যন্ত লম্বা জামার হাত থেকে চার ইঞ্চি চওড়া লেসের ঝালর ঝুলত, পায়ে থাকত কালো মোজা আর ছোট্ট একটুখানি গোড়ালি তোলা বন্ধ জুতো।”
ব্রাহ্মসমাজের রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে শান্তাদেবী লিখেছিলেন, ‘‘তিনি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবাদিতে আমাদের বাড়িতে আসতেন। …কাদম্বিনী ভাল ডাক্তার ছিলেন এবং খুব কড়া কড়া কথা বলতেন, অপ্রিয় সত্য বলতে ভয় পেতেন না। নিজের ছেলেমেয়েদেরও বাদ দিতেন না।’’ সৎ মেয়ে বিধুমুখীর সঙ্গে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল তাঁর আজীবন। স্বামীর প্রথম পক্ষের অসুস্থ ছেলেটিকে মাতৃস্নেহে বুকে নিয়েছিলেন। বিধবা ননদকে সারাজীবন গভীর শ্রদ্ধা করছেন, সামাজিক নিয়ম মেনে তাঁর খাবার রান্না করে দিয়েছেন।
ছেলেমেয়েদের জামায় নিজের হাতে সূঁচসুতো দিয়ে শিল্পসৃষ্টি করছেন। অন্য দৃশ্যে কন্যা জ্যোতির্ময়ী বেথুন স্কুলে্র নিয়ম ভেঙে রঙিন শাড়ি ও বড়গলার ব্লাউজ পরার জন্য তাকে তিরষ্কার করছেন। আবার স্নেহে্র পুত্রবধূ কে চিঠি দিয়েছেন, ”কাল বিকালেও রাঁধুনি আইসে নাই। আজও ক্যাঁও ক্যাঁও করিয়াছে শরীর ভাল না। কাল আসিবে কি না জানি না।’”
একই সঙ্গে স্বামী, সংসার, সন্তান সামলে নিজের জেদ বজায় রেখেছিলেন কাদম্বিনী। স্বামীর সমর্থনে, ঘরে-বাইরে নাগাড়ে যুদ্ধ করে চলা এই নারী দেখিয়েছিলেন, ইচ্ছে থাকলে সব হয়।
তাঁর খ্যাতির জন্য তিনি ১৮৯৫ সালে সুদূর নেপাল থেকে ডাক পান রাজমাতার চিকিৎসার জন্য। নেপালের রাজা জঙ বাহাদুরের মা খুব অসুস্থ হলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে কাদম্বিনীকে ডেকে পাঠানো হল। তাঁর ওষুধে রাজমাতা সুস্থ হলেন। কাদম্বিনীকে আলাদা প্রাসাদে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। সোনা-রুপোর থালাবাসনে খেতে দেওয়া হত। ফেরার সময়ে রাজমাতাকে সারিয়ে তোলার পুরস্কার হিসেবে প্রচুর অর্থ, দামি পাথর বসানো সোনার গহনা, মুক্তোর মালা, রুপোর বাসন, তামা-পিতল-হাতির দাঁতের জিনিস আর একটি সাদা রঙের গোলগাল, জ্যান্ত টাট্টু ঘোড়া দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপেই তিনি কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রোগী দেখতে ছুটতেন। রাস্তায় যাওয়ার সময়টুকু অনবরত লেস বুনে যেতেন! যে দক্ষতায় অস্ত্রোপচারে ছুরি চালাতেন, সেই দক্ষতাতেই তৈরি করতে পারতেন অপূর্ব সব লেসের নকশা। কাদম্বিনী ছিলেন সূচিশিল্পেও বেশ নিপুণা। অবসর সময়ে বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ করতেন তিনি। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ প্রবাদকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি করে, সময় ও সমালোচনাকে পদানত করেছিলেন কাদম্বিনী!
শুরু হয় কাদম্বিনীর একা পথচলা
১৮৯৮ সালের ২৭শে জুন মৃত্যু হয় দ্বারকানাথের। সেই বেথুন স্কুলে পড়ার সময় থেকে যিনি প্রতি মুহূর্ত্তে কাদম্বিনীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন,পায়ের জমি শক্ত করেছেন, প্রয়োজনমত দশভুজা স্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন, তিনি কাদম্বিনীকে একা রেখে অনন্তের পথে যাত্রা করলেন। এই মহাবিচ্ছেদের পরেও প্রায় চব্বিশ বছর কাদম্বিনী ঘরে ও বাইরে তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখেন। আটটি (কেউ বলেছেন ন’টি) ছেলেমেয়ের প্রত্যেককে কৃতী মানুষ করে তোলেন, তাদের বিয়ে দেন, নাতি ও নাতনীদের নিয়ে তাঁর বিশাল সংসার ছিল জমজমাট।
দ্বারকানাথের মৃত্যুর দিন বিকেলে কলকাতার এক জমিদার বাড়ি থেকে কাদম্বিনীকে প্রসব করানোর জন্য ‘কল’ দেওয়া হয়। সকালে স্বামীহারা চিকিৎসক বিকেলে তাঁর ব্যাগপত্র নিয়ে সেখানে রওনা দেন। হতবাক ও অসন্তুষ্ট আত্মীয়দের বলেছিলেন, ‘‘যে গেছে সে তো আর ফিরবে না, যে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আসছে তাকে তো আনতে হবে!’’ বড় আশ্চর্য ছিল তাঁর জীবন। অন্য ধাতুতে গড়া ছিল মন। নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতেন সব সময়। পরিবারের সদস্যেরা কেউ রাত ন’টার পরে বাড়ি ঢুকলে রাতের খাবার দেওয়া হত না।
কাদম্বিনী-দ্বারকানাথ ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে পনেরো বছরের দাম্পত্য জীবন কাটান। ওই বাড়িরই তিন তলায় তাঁরা থাকতেন। দোতলায় সংসার ছিল বিধুমুখী ও উপেন্দ্রকিশোরের। স্বামীর মৃত্যুর পরে কাদম্বিনী চলে যান ৬ নম্বর গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনের বাড়িতে।
কাদম্বিনী দেবীর বিদায়বেলা
১৯২৩ সালের ৩ অক্টোবর এক বুধবার, ৬২ বছর বয়স্কা কাদম্বিনী সকাল ৯ টা অবধি কাঁথাতে নক্সা তুলেছেন। জীবনের শেষ দিনটাতেও কাদম্বিনী রোগীর বাড়ি গেছেন। জটিল অস্ত্রোপচার করেছেন।
নারায়ণ দত্ত লিখেছেন, বাড়ি ফিরে পরিতৃপ্ত কাদম্বিনী পুত্রবধূ সরলাকে বলেছিলেন
“বউমা, লোকে বলতে শুরু করেছে, ডাক্তার গাঙ্গুলী নাকি বুড়ো হয়ে গেছেন, তাঁর হাত আর আগের মত চলে না। আজ যে অপারেশন করে এলাম, সে্টা দেখলে তারা আর এ কথা বলতে সাহস করবে না ।”
স্বাতী ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিনি বলেন “আমার আজ উড়তে ইচ্ছে করছে।”
সাবলম্বী, স্বাধীনচেতা কাদম্বিনী সবসময় বলতেন তিনি কারো কাছে এমনকি নিজ পুত্রেরও গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না। কর্মাবস্থায় তাই মরতে চেয়েছিলেন তিনি। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে শরীর আর তাঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না। পুত্রবধূর সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরই স্নান করতে গিয়ে কঠিন সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই মহিলা ডাক্তার। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর হাত ব্যাগে পাওয়া যায় পঞ্চাশ টাকা। তাঁর শেষ রোজগার। ইতিহাস সৃষ্টিকারী চিকিৎসকের সম্মানে সেই টাকা খরচ করা হয়েছিল তাঁর শেষকৃত্যে।
১৪ই অক্টোবর ১৯২৩, ছিল তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। ব্রাহ্মসমাজে উপাসনা করেছিলেন শ্রদ্ধেয় হেরম্বচন্দ্র মৈত্র মহাশয়। কাদম্বিনী তর্পণ খুব ভালোবাসতেন, সেদিন প্রভাতচন্দ্র তর্পণ ও জীবনী পাঠ করেছিলেন।
অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, বিদুষী এই মহিলা কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, যাঁর ঝুলিতে রয়েছে একগুচ্ছ রেকর্ড।
- তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন।
- তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক।
- তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি ভারতীয় মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে ‘গ্র্যাজুয়েট অব দ্য মেডিকেল কলেজ অব বেঙ্গল’ উপাধি পান।
- ভারত উপমহাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনি-ই প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি ডাক্তারি শাস্ত্রের একাধিক বিদেশি ডিগ্রি অর্জনের দুর্লভ দক্ষতা দেখান।
- তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসারীতিতে চিকিৎসা করবার অনুমতি পেয়েছিলেন।
- কাদম্বিনী জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সদস্যদের অন্যতমা, কংগ্রেস অধিবেশনে (১৮৮৯ সালে বোম্বাইতে) যোগ দেওয়া প্রথম দুই নারী প্রতিনিধির মধ্যে একজন।
- কাদম্বিনী সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তিনি প্রথম নারী বক্তা।
নান্দীকার গোষ্ঠী মঞ্চস্থ করেছেন একটি নাটক “রাণী কাদম্বিনী”।
“কালজয়ী কাদাম্বিনী” – ডঃ সুনীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
ভারতীয় বাংলার দুই চ্যানেল জি বাংলা (Zee Bangla) এবং স্টার জলসা (Star Jalsha) পর্দায় বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে এই মহীয়সী নারী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন বায়োপিক হিসেবে হাজির করছে তারা। স্টার জলসার মেগার নাম ‘প্রথমা কাদম্বিনী’। জি বাংলায় শুধু ‘কাদম্বিনী’।
লিখেছেন – সৈয়দা ফতিমা মম